দি কিলিং অফ আ সেইক্রেড ডিয়ার (২০১৭)
লান্থিমোস মানেই সিম্বোলিজম, কাহিনীর অন্তরালের কাহিনী...আর এক্সপেক্টেশনের পরাজয়। তাই 'দি কিলিং অফ দি সেইক্রেড ডিয়ার' এর শুরুটায় যখন দেখা যায় লং টেক-এ একটা জীবন্ত হৃদপিন্ড, ব্যাকগ্রাউন্ডে শুবার্টের সাবাট মেটার ডি৩৮৩ - 'জিসাস ক্রাইস্ট হ্যাংস অন আ ক্রস': প্রায়... ধর্মীয় আবেগঘন, 'সেইক্রেড' এক পরিবেশ, যাকে 'শকার' দিয়ে দুমরে মুচড়ে দিয়েছেন ডিরেক্টর, তখনই কিছুটা আঁচ করা যায় কাহিনীর গভীরতা। শুরু হয় অন্ধকার, অন্ধকার এক থ্রিলার।
ডিরেক্টরের একটা জিনিস খুব চোখে পড়ে, জাম্পকাটের মধ্য দিয়ে নতুন এমন এক তথ্য দেওয়া যার মধ্যে দিয়ে সেই জগতটার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে সত্যি বলতে তার আগের কাজগুলোর স্থান প্রায় 'সারিয়েল' এক জগতে, যার সম্পর্কে কিছুই জানা নেই বললেই চলে। তাই সেগুলো আমাদের যেমন চমকে দেয়, তেমনি সেই বাস্তবতা নিয়ে আমাদের জ্ঞানে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। পক্ষান্তরে, 'সেইক্রেড ডিয়ার' এর অবস্থান আমাদের এই পৃথিবীতেই, এই বাস্তব ডাইমেনশনে। সেই দিক থেকে তিনি বেশ ছাড় পেয়েছেন, এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, সহলেখক ফিলিপো ও তার সবসময়ের সহযোগী সিনেমাটোগ্রাফার বাকাতাকিস। টিমওয়ার্কের আদর্শ উদাহরণ। এভাবে যেই কাহিনীটা চোখের সামনে ভাঁজে ভাঁজে খুলতে থাকে, তা তাদের আগের কাজের চেয়ে বেশ ভিন্ন ধরনের।
বিশেষ করে, লংটেক আর ক্লোজআপ শটের আধিক্যঃ প্রধান চরিত্র স্টিভেন মার্ফির বিহবলতা, ও ইন্ট্রোস্পেকশনের দীর্ঘ চিত্রায়ন, বা স্ত্রী অ্যানের এক ভ্রু বাঁকানো। লান্থিমোসকে অনেক সময়েই দেখা যায় ডিটেইলের প্রতি বেশ মনোযোগী; এই সিনেমাটিও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং বলা যায় হয়তো আরো বেশি সফল সেই দিক থেকে। সবচেয়ে বেশি আমার চোখে পড়েছে উজ্জ্বল নীল ও হলুদের কন্ট্রাস্টিং কম্বিনেশনের প্রতি একধরনের ভক্তি একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ( ভিসুয়াল কিউয়ের প্রতি খেয়াল রাখলে সিনেমার ক্লাইমেক্স অংশে এর পরিণতি নিয়ে একটা হিন্ট পাওয়া যেতে পারে )।
কম্বিনেশন ছাড়াও, উজ্জ্বলতা একটা প্লাস। সিনেমার একটু ভিতরেই, (বা সিনেমার ডিস্ক্রিপশনে) আমরা জানতে পারি যে মারফি পরিবার বেশ ধনাঢ্য, উচ্চাভিলাষীঃ হসপিটালের চকচকে অফিস, পরিপাটি রুম - সব যেন এই কথাটাই বারবার মনে করিয়ে দেয়; তাদের জীবনটা 'নিখুঁত'...আসলেই কি তাই?
পরিচালক আমাদের প্রতীক্ষাকে যেমন 'সাবভার্ট' করেন, কিন্তু তাই বলে সিকোয়েন্সগুলোর মাঝখানে দম ফেলার মতো সময় দেয়া হয় বল্লেও ভুল হবে। তার দৃশ্যগুলো প্রায় সবগুলোই অফ-স্ক্রিন মিউজিক বর্জিত, কিন্তু সেগুলোর মাঝখানের সময়গুলো ভরাট করার জন্য আছে থমথমে, লোও-পিচ, অ্যাট্মোস্ফিয়ারিক সুর - দর্শককে মনে করিয়ে দিতে বাধ্য, সবকিছু এখনো অসামঞ্জস্য।
আরেকটা মাত্রা হচ্ছে লান্থিমোসের 'ট্রেডমার্ক' ডায়ালগঃ একসুরে, মনোটোনাস কণ্ঠে সাবলীলভাবে বলতে থাকা কথাঃ যেই সুরে বলা 'গুডনাইট', সেই সুরেই কলিগকে বলা তার কন্যার মেন্সট্রুয়েশনের কথা - সেই ব্যাকগ্রাউন্ড সুরগুলোর মতনই খাপছাড়া।
যদিও সিনেমার পরবর্তী পর্যায়গুলোতে চরিত্রগুলোকে এই মার্জিন থেকে সরে আসতে দেখা যায়, আরেকটু বেশি দেখা যায় অনুভূতির প্রকাশ (বিশেষ করে অ্যানাকে) যেটা আমার কাছে নতুন ছিলো; হয়তো চরিত্রগুলোর সাথে যেন আমরা আরেকটু বেশি সিম্প্যাথাইজ করতে পারি...?
আগে বলেছি লান্থিমোসকে ক্রিটিকরা যে মাইকেল হানিকির সাথে তুলনা করে থাকেন। এখানে তুলনাটা আরো বেশি করে এসে পড়ার কথা, বিশেষ করে তাঁর 'ফানি গেইমস' এর সাথে। চরিত্রগুলোর মধ্যে নৈতিকতাবোধের সংজ্ঞা আর কি 'নর্মাল' তা নিয়ে প্রশ্ন আসতে থাকে পদে পদে, যা আমাদের মধ্যেও দ্বিধা তৈরি করতে বাধ্য। এভাবে বাস্তব জগতের মধ্যেই একধরনের 'সারিয়েল' প্রভাব তৈরি করে ফেলেছেন পরিচালক।
যেমন, শিশুকিশোরের সাধারণ ঝগড়া বেঁচে থাকার ইচ্ছা থেকে যে কুটিল্ভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, তাকে অতটা নিষ্পাপ বলাটা কোনভাবেই সম্ভব নয় । আবার, রাতে বিছানায় স্ত্রীকে 'অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া রোগী' হিসেবে রোলপ্লেই করতে বলা স্টিভেনের মনে সাধারণত অপারেটিং টেবিলে কি চলতে থাকে তা নিয়ে অনেকক্ষ্ণ চিন্তাগ্রস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। এভাবে ভিসুয়াল ও অডিও ছাড়াও কাহিনীর প্রয়োগ দিয়ে পরিচালক যে একধরনের অস্বস্তিবোধকে জিইয়ে রাখেন, তা থেকে সিনেমাটি থ্রিলারের গলি ছাপিয়ে হররের দিকে মোড় নেয় অনেক সাবলীল্ভাবে; যেসব ক্রিটিকরা একে 'সাস্পেন্স' বা 'থ্রিলার' এর চেয়ে সুদক্ষ 'হরর' বলেছেন তাদের সাথে একমত হতেই হয়।
তবে সবচেয়ে সারিয়েল অংশটা অর্থাৎ সিনেমাটির অতিপ্রাকৃত দিকটির উৎপত্তি লেখকদের নিজ দেশের মিথোলজি থেকেঃ ইফাজোনিয়ার কাহিনী, যে ছিলো আগামেমননের কন্যা। সিনেমাটির টাইটেল থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট ধারণাটি হলো, কাহিনী প্রধানত গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিডিসের 'ইফাজোনিয়া এন অলিডি' এর অনুসারী, যেখানে ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া আগামেমনন দেবী আর্টেমিসের এক বিশেষ হরিণকে মেরে ফেলেন, এরপর দেবীর ক্রোধ মেটাতে নিজের কন্যা ইফাজোনিয়াকে বলি হিসেবে দিতে রাজি হন তিনি।
এই কাহিনীটির সাথে সিনেমার গল্পের মিল অবশ্য শুধুই সিম্বোলিক; কথাপ্রসঙ্গে, যখন মার্টিন বলে, "Do you understand? It's a metaphor. It's symbolic." তখন সেটা অগাস্টাস ওয়াটারের সিগারেট মেটাফোরের চেয়ে একটু বেশি প্রভাব ফেলার মতো, বলা যায় নিঃসন্দেহে। An Eye for an Eye - উক্তিটার বাস্তব, আরও দুর্ধর্ষ প্রয়োগ।
তবে সিনেমার গা-ছমছম করানোর মত ব্যাপারগুলো যতটা সুপারন্যাচারাল, ঠিক ততটাই সাইকোলজিক্যাল। পরিচালক কোন একটা মানসিক ব্যাপারকে যে কতটা গভীর পর্যন্ত ঘাটতে পারেন সুদক্ষভাবে, সেটিই আবার দেখা গেল। বিশেষ করে শেষ মূহুর্তের কাছাকাছি সময়ে ববের কার্যালাপে।
লান্থিমোস নিয়ে কথা হবে, আর ব্ল্যাক কমেডি থাকবেনা তা কি হয়? মতান্তরে এই সিনেমাটি তার সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিরিয়াস, যে কিছু দৃশ্যে ডার্ক হিউমার আছে সেগুলো আরো বেশি 'ডার্ক'। বিশেষ করে সিনেমার ক্লাইমেক্সের দৃশ্যায়ণ যেভাবে করে চলতে থাকে, একদিকে যেমন কমেডি সিনেমার ইলিমেন্ট, তেমনি আরেকদিকে বাস্তব একটা আশঙ্কা। এখানে বিভিন্ন রিলেশনশিপের ডাইনামিক নিয়েও বলার আছে অনেক কিছু। একদিক দিয়ে বলা যায়, তার সিনেমাগুলোতে এই রিলেশনশিপগুলো নিজেরাই একটা চরিত্র - অ্যাবসার্ডিস্ট ধাঁচের। এজন্য হয়তো মায়ের মুখে শিশুদেরকে নিয়ে স্টিভেনের কাছে সাবলীল্ভাবে যা বলতে শোনা যায়, বা যখন কিশোরীর ভালোবাসার মানুষের পিছনে বাইকে বসে ছুটে চলার সেই স্বপ্নালু দৃশ্যটাকে দুঃস্বপ্নের কাছাকাছি বলেই বোধ হয়, তখন সেটাকে খাপছাড়া মনে হয়না কিছুতেই। মডার্ন সারিয়েলিজমের উচ্চাসনে থাকা ডেভিড লিঞ্চের মতই এই দিক দিয়ে অসম্ভব পারদর্শী লান্থিমোস।
গ্রিক ট্র্যাজিকমেডিগুলোর মূল বক্তব্য যেখানে মানুষ-দেবতার দ্বন্দ্ব, সেখানে 'সেইক্রেড ডিয়ার' এ ফুঁটে উঠেছে প্রতিশোধ, মানবচরিত্রের নিম্নতম পর্যায়, অনুভূতির প্রতি একধরনের নিহিলিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ বিষয়গুলো ফুঁটিয়ে তুলতে সুদক্ষ পরিচালক লান্থিমোসের মত কমই আছে বলতে হবে। দ্বিতীয়বার দেখার পরও বেশ কিছু দৃশ্য নিয়ে ঘোর এখনও থেকে যায়। অনেক দিক থেকে, পার্সোনালি, এই সিনেমাটি আমার কাছে তার এ পর্যন্ত সবচেয়ে সবচেয়ে পলিশড, সেরা সিনেমা বলেই মনে হয়েছে। সিনেমার আর্টিস্টদের অসাধারণ অভিনয় আরেকটা বিশেষ পাওয়া।
ডিরেক্টরের একটা জিনিস খুব চোখে পড়ে, জাম্পকাটের মধ্য দিয়ে নতুন এমন এক তথ্য দেওয়া যার মধ্যে দিয়ে সেই জগতটার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে সত্যি বলতে তার আগের কাজগুলোর স্থান প্রায় 'সারিয়েল' এক জগতে, যার সম্পর্কে কিছুই জানা নেই বললেই চলে। তাই সেগুলো আমাদের যেমন চমকে দেয়, তেমনি সেই বাস্তবতা নিয়ে আমাদের জ্ঞানে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। পক্ষান্তরে, 'সেইক্রেড ডিয়ার' এর অবস্থান আমাদের এই পৃথিবীতেই, এই বাস্তব ডাইমেনশনে। সেই দিক থেকে তিনি বেশ ছাড় পেয়েছেন, এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, সহলেখক ফিলিপো ও তার সবসময়ের সহযোগী সিনেমাটোগ্রাফার বাকাতাকিস। টিমওয়ার্কের আদর্শ উদাহরণ। এভাবে যেই কাহিনীটা চোখের সামনে ভাঁজে ভাঁজে খুলতে থাকে, তা তাদের আগের কাজের চেয়ে বেশ ভিন্ন ধরনের।
বিশেষ করে, লংটেক আর ক্লোজআপ শটের আধিক্যঃ প্রধান চরিত্র স্টিভেন মার্ফির বিহবলতা, ও ইন্ট্রোস্পেকশনের দীর্ঘ চিত্রায়ন, বা স্ত্রী অ্যানের এক ভ্রু বাঁকানো। লান্থিমোসকে অনেক সময়েই দেখা যায় ডিটেইলের প্রতি বেশ মনোযোগী; এই সিনেমাটিও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং বলা যায় হয়তো আরো বেশি সফল সেই দিক থেকে। সবচেয়ে বেশি আমার চোখে পড়েছে উজ্জ্বল নীল ও হলুদের কন্ট্রাস্টিং কম্বিনেশনের প্রতি একধরনের ভক্তি একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ( ভিসুয়াল কিউয়ের প্রতি খেয়াল রাখলে সিনেমার ক্লাইমেক্স অংশে এর পরিণতি নিয়ে একটা হিন্ট পাওয়া যেতে পারে )।
কম্বিনেশন ছাড়াও, উজ্জ্বলতা একটা প্লাস। সিনেমার একটু ভিতরেই, (বা সিনেমার ডিস্ক্রিপশনে) আমরা জানতে পারি যে মারফি পরিবার বেশ ধনাঢ্য, উচ্চাভিলাষীঃ হসপিটালের চকচকে অফিস, পরিপাটি রুম - সব যেন এই কথাটাই বারবার মনে করিয়ে দেয়; তাদের জীবনটা 'নিখুঁত'...আসলেই কি তাই?
পরিচালক আমাদের প্রতীক্ষাকে যেমন 'সাবভার্ট' করেন, কিন্তু তাই বলে সিকোয়েন্সগুলোর মাঝখানে দম ফেলার মতো সময় দেয়া হয় বল্লেও ভুল হবে। তার দৃশ্যগুলো প্রায় সবগুলোই অফ-স্ক্রিন মিউজিক বর্জিত, কিন্তু সেগুলোর মাঝখানের সময়গুলো ভরাট করার জন্য আছে থমথমে, লোও-পিচ, অ্যাট্মোস্ফিয়ারিক সুর - দর্শককে মনে করিয়ে দিতে বাধ্য, সবকিছু এখনো অসামঞ্জস্য।
আরেকটা মাত্রা হচ্ছে লান্থিমোসের 'ট্রেডমার্ক' ডায়ালগঃ একসুরে, মনোটোনাস কণ্ঠে সাবলীলভাবে বলতে থাকা কথাঃ যেই সুরে বলা 'গুডনাইট', সেই সুরেই কলিগকে বলা তার কন্যার মেন্সট্রুয়েশনের কথা - সেই ব্যাকগ্রাউন্ড সুরগুলোর মতনই খাপছাড়া।
যদিও সিনেমার পরবর্তী পর্যায়গুলোতে চরিত্রগুলোকে এই মার্জিন থেকে সরে আসতে দেখা যায়, আরেকটু বেশি দেখা যায় অনুভূতির প্রকাশ (বিশেষ করে অ্যানাকে) যেটা আমার কাছে নতুন ছিলো; হয়তো চরিত্রগুলোর সাথে যেন আমরা আরেকটু বেশি সিম্প্যাথাইজ করতে পারি...?
আগে বলেছি লান্থিমোসকে ক্রিটিকরা যে মাইকেল হানিকির সাথে তুলনা করে থাকেন। এখানে তুলনাটা আরো বেশি করে এসে পড়ার কথা, বিশেষ করে তাঁর 'ফানি গেইমস' এর সাথে। চরিত্রগুলোর মধ্যে নৈতিকতাবোধের সংজ্ঞা আর কি 'নর্মাল' তা নিয়ে প্রশ্ন আসতে থাকে পদে পদে, যা আমাদের মধ্যেও দ্বিধা তৈরি করতে বাধ্য। এভাবে বাস্তব জগতের মধ্যেই একধরনের 'সারিয়েল' প্রভাব তৈরি করে ফেলেছেন পরিচালক।
যেমন, শিশুকিশোরের সাধারণ ঝগড়া বেঁচে থাকার ইচ্ছা থেকে যে কুটিল্ভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, তাকে অতটা নিষ্পাপ বলাটা কোনভাবেই সম্ভব নয় । আবার, রাতে বিছানায় স্ত্রীকে 'অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া রোগী' হিসেবে রোলপ্লেই করতে বলা স্টিভেনের মনে সাধারণত অপারেটিং টেবিলে কি চলতে থাকে তা নিয়ে অনেকক্ষ্ণ চিন্তাগ্রস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। এভাবে ভিসুয়াল ও অডিও ছাড়াও কাহিনীর প্রয়োগ দিয়ে পরিচালক যে একধরনের অস্বস্তিবোধকে জিইয়ে রাখেন, তা থেকে সিনেমাটি থ্রিলারের গলি ছাপিয়ে হররের দিকে মোড় নেয় অনেক সাবলীল্ভাবে; যেসব ক্রিটিকরা একে 'সাস্পেন্স' বা 'থ্রিলার' এর চেয়ে সুদক্ষ 'হরর' বলেছেন তাদের সাথে একমত হতেই হয়।
তবে সবচেয়ে সারিয়েল অংশটা অর্থাৎ সিনেমাটির অতিপ্রাকৃত দিকটির উৎপত্তি লেখকদের নিজ দেশের মিথোলজি থেকেঃ ইফাজোনিয়ার কাহিনী, যে ছিলো আগামেমননের কন্যা। সিনেমাটির টাইটেল থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট ধারণাটি হলো, কাহিনী প্রধানত গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিডিসের 'ইফাজোনিয়া এন অলিডি' এর অনুসারী, যেখানে ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া আগামেমনন দেবী আর্টেমিসের এক বিশেষ হরিণকে মেরে ফেলেন, এরপর দেবীর ক্রোধ মেটাতে নিজের কন্যা ইফাজোনিয়াকে বলি হিসেবে দিতে রাজি হন তিনি।
এই কাহিনীটির সাথে সিনেমার গল্পের মিল অবশ্য শুধুই সিম্বোলিক; কথাপ্রসঙ্গে, যখন মার্টিন বলে, "Do you understand? It's a metaphor. It's symbolic." তখন সেটা অগাস্টাস ওয়াটারের সিগারেট মেটাফোরের চেয়ে একটু বেশি প্রভাব ফেলার মতো, বলা যায় নিঃসন্দেহে। An Eye for an Eye - উক্তিটার বাস্তব, আরও দুর্ধর্ষ প্রয়োগ।
তবে সিনেমার গা-ছমছম করানোর মত ব্যাপারগুলো যতটা সুপারন্যাচারাল, ঠিক ততটাই সাইকোলজিক্যাল। পরিচালক কোন একটা মানসিক ব্যাপারকে যে কতটা গভীর পর্যন্ত ঘাটতে পারেন সুদক্ষভাবে, সেটিই আবার দেখা গেল। বিশেষ করে শেষ মূহুর্তের কাছাকাছি সময়ে ববের কার্যালাপে।
লান্থিমোস নিয়ে কথা হবে, আর ব্ল্যাক কমেডি থাকবেনা তা কি হয়? মতান্তরে এই সিনেমাটি তার সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিরিয়াস, যে কিছু দৃশ্যে ডার্ক হিউমার আছে সেগুলো আরো বেশি 'ডার্ক'। বিশেষ করে সিনেমার ক্লাইমেক্সের দৃশ্যায়ণ যেভাবে করে চলতে থাকে, একদিকে যেমন কমেডি সিনেমার ইলিমেন্ট, তেমনি আরেকদিকে বাস্তব একটা আশঙ্কা। এখানে বিভিন্ন রিলেশনশিপের ডাইনামিক নিয়েও বলার আছে অনেক কিছু। একদিক দিয়ে বলা যায়, তার সিনেমাগুলোতে এই রিলেশনশিপগুলো নিজেরাই একটা চরিত্র - অ্যাবসার্ডিস্ট ধাঁচের। এজন্য হয়তো মায়ের মুখে শিশুদেরকে নিয়ে স্টিভেনের কাছে সাবলীল্ভাবে যা বলতে শোনা যায়, বা যখন কিশোরীর ভালোবাসার মানুষের পিছনে বাইকে বসে ছুটে চলার সেই স্বপ্নালু দৃশ্যটাকে দুঃস্বপ্নের কাছাকাছি বলেই বোধ হয়, তখন সেটাকে খাপছাড়া মনে হয়না কিছুতেই। মডার্ন সারিয়েলিজমের উচ্চাসনে থাকা ডেভিড লিঞ্চের মতই এই দিক দিয়ে অসম্ভব পারদর্শী লান্থিমোস।
গ্রিক ট্র্যাজিকমেডিগুলোর মূল বক্তব্য যেখানে মানুষ-দেবতার দ্বন্দ্ব, সেখানে 'সেইক্রেড ডিয়ার' এ ফুঁটে উঠেছে প্রতিশোধ, মানবচরিত্রের নিম্নতম পর্যায়, অনুভূতির প্রতি একধরনের নিহিলিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ বিষয়গুলো ফুঁটিয়ে তুলতে সুদক্ষ পরিচালক লান্থিমোসের মত কমই আছে বলতে হবে। দ্বিতীয়বার দেখার পরও বেশ কিছু দৃশ্য নিয়ে ঘোর এখনও থেকে যায়। অনেক দিক থেকে, পার্সোনালি, এই সিনেমাটি আমার কাছে তার এ পর্যন্ত সবচেয়ে সবচেয়ে পলিশড, সেরা সিনেমা বলেই মনে হয়েছে। সিনেমার আর্টিস্টদের অসাধারণ অভিনয় আরেকটা বিশেষ পাওয়া।
This comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDelete