ডিকন্সট্রাক্টিং অ্যান্টিপর্নো
ঘন হলুদের মধ্যে চেরি ব্লসম লাইট ট্রি এর ব্যাকগ্রাউন্ড, সামনে নৃত্যরত কিয়োকো (তোমিতে আমি) এই ওপেনিং সিন দিয়ে শুরু সিওন সোনোর লিখিত ও পরিচালিত 'এন্টিপর্নো' ।
মূলতঃ জাপানি পিঙ্ক ফিল্ম/ সফ্টকোর পর্নোর একটি ধারা 'রমোঁ পর্নো' এর অগ্রদূত স্টুডিও নিক্কাৎসুর নতুন উদ্যোগ সেই সত্তর-আশি দশকে দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানো ধারাটার এক্সপেরিমেন্টাল রিবুট বড় পর্দায় আনা, তার অংশ হিসেবে নিক্কাৎসুর ব্যানারে মুক্তি পেয়েছে 'ওয়েট ওম্যান ইন দি উইন্ড' , 'অ্যারাউসড বাই জিম্নোপেডিস' এর মত সিনেমা, আর সাথে সোনোর অবদান। সোনো, যিনি স্বঘোষিত প্রথাবিরোধী, নিজেকে এন্টি-ওজু (জাপানি পরিচালক ওজু ইয়াসুজিরো) দাবি করেছেন, 'সুইসাইড সার্কল' এর মত সিনেমা তৈরি করেছেন জাপানিদের কাছ থেকে ঘৃণা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে, তার কাছে থেকে এটাই আশা করা যায় যে রমোঁ পর্নোর পথে নেমে ভিন্ন কিছু উন্মোচিত করবে এই সোয়া এক ঘন্টার সিনেমাটি। তার আগে কিছুটা ব্যাকড্রপ।
নৃত্য- ও চিত্র-শিল্পী কিয়োকোর নির্জন ফ্ল্যাটে তাকে দেখা যায় নিজের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে, ধীরে ধীরে এই ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে তার অ্যাসিস্টেন্ট নোরিকোর প্রতি। তার আগে শুরুতে আমরা কিছুক্ষ্ণ দেখি তার সাথে তার বোনের কিছু কথোপকথন, যাতে উঠে আসে প্রজাপতি, আর বোতলে বন্দি বিশাল গিরগিটি, যে তার পালানোর পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখানে কি কিছু সিম্বোলিজম উপস্থিত?
সোনোর সিনেমার অনেক বৈশিষ্ট্য থেকেই সিনেমাটা বেশ ভিন্ন। তার কাজে সাধারণত ম্যাক্সিমালিস্ট ভাবধারা বেশি প্রতীয়মান হয়ঃ রঙের ছড়াছড়ি, কেওয়াজ। পক্ষান্তরে শুরুতেই আমরা দেখি সেটটাতে আসবাবের সীমাবদ্ধ ব্যবহার , মিনিমালিজম, আর উজ্জ্বল কন্ট্রাস্টপূর্ণ রঙের কাজ, যাতে সিনেমাটোগ্রাফার ইতো মাকির চিহ্ন বিদ্যমান, যাকে আগে দেখা গিয়েছে মেট্রোসেক্সুয়াল, হারাজুকু-ফ্যাশন-অনুপ্রাণিত পরিবেশকে ঘিরে কাজ করতে। এছাড়াও সাধারণত শুরুতেই আমরা কাহিনীর যে একটা আঁচ পেয়ে যাই তাও এখানে স্পষ্ট নয় শুরুতে (যদিও ধীরে ধীরে সিনেমাটি গতি বৃদ্ধি করতে থাকে)।
নিয়ম ভাঙার আগে নিয়ম যে মেনে নিতে হয়, সেটা সোনোর কাজে চিত্রমান। নিক্কাৎসু সফটকোরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য 'প্রতি দশ মিনিটে একটা সেক্স সীন' এবং 'চিপ ন্যুডিটি' তো আছেই। কিন্তু সিনেমা যতটাই আগাতে থাকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে এই দৃশ্যগুলো যতটা না আনন্দ দেওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি বিচলিত করে।
বলা যায়, তিনি নিজের কিছু নিয়মকে যেমন পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন, তেমনি কৌশলে উপেক্ষা করেছেন নিক্কাৎসুর ট্র্যাডিশনকেও।
তবে আমাদের চির-পরিচিত ডিরেক্টরের চিহ্ন ও মেসেজের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই, একটু অন্যভাবে, কিন্তু স্পষ্টই বিদ্যমান। কিয়োকোর কিছুটা খাপছাড়া চেচামেচি পরিবেশকে শান্ত হতে দেয়না কিছুতেই। এরপর যখন এডিটর, ফটোগ্রাফারের দল আসে তখন সিনেমাটি আরেকটু বিকৃতির দিকে মোড় নেয়। সোনো তার ম্যাক্সিমালিজম বজায় রাখেন এভাবে। শুরুতে যদি কিছুটা এলোমেলো লাগতে থাকে চরিত্রগুলোকে, পর্যায়ক্রমে সূক্ষতা কিন্তু দক্ষতার সাথে দেখা যায় কিভাবে কাহিনী একজায়গায় এসে পড়ছে, আর আমরা পরিচিত হই একের পর এক টুইস্টের সাথে। একসময় কিয়োকোর পূর্ব জীবনের একাংশ পর্দায় ফুটে উঠে।
সোনোর কাজগুলো স্পষ্ট ক্যারেক্টার স্টাডি হিসেবে বলা যায়না কখনোই, এবং এখানে কিয়োকোর বর্তমান পরিস্থিতিতে সে যে কিভাবে আসলো তার কারণ না পাওয়াটাই স্বাভাবিক, বিশেষত বেশ আজগুবি (পড়ুন ইন্যাপ্রোপ্রিয়েট) ডিনার টেবিল কনভার্সেশন, আর চিত্রায়ণ যেগুলো কিছুটা স্কিটজোফ্রেনিক পর্যায়ে পড়ে।
তবে এখানে মনে পড়ে যায় সোনোর নিজের উক্তি, তার ভাষায় প্যারাফ্রেজ করলে, মানুষ ঈশ্বর, বা ধর্ম খোঁজে মূলতঃ শান্তির সন্ধানে, সম্পর্কের সন্ধানে, যে কারণে মানুষ সহজেই কাল্টে যোগ দিয়ে ফেলে। কথাটি 'সুইসাইড সার্কল' সিনেমাটির ব্যাকগ্রাউন্ডে হলেও, এ সিনেমাটির ক্ষেত্রে কি প্রযোজ্য নয়? আমরা এখানে পুরুষ-প্রধান ফিল্মিং ক্রিউ, আর হিংস্র অভিনেত্রীগুলোকে যেভাবে জোট বেঁধে থাকতে দেখি, তেমনি দেখি এই গ্রুপের প্রতি কিয়োকোর অন্ধভক্তি, আর যোগ দেওয়ার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা। এছাড়াও কাল্টের প্রতি যে ভক্তি তৈরি হয় সাবকনশাসভাবে, তার কারণগুলোর মধ্যে দুইটি হলো, চরম একাকীত্ব, আর কাল্টের প্রতি একধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করে ফেলা। এটা খুব সহজেই চোখে পড়ে কিভাবে কিয়োকো একাকীত্বে বন্দি হয়ে পড়েছিল, যাতে তার বাসার পরিবেশ আরো বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয়ত, তার চেপে রাখা যৌনতাড়নাকে পরিস্ফূটিত করতে সাহায্য করে সেই 'ফিল্মিং সেট'।
যদিও দেখা যায় সিনেমার প্রথমদিকে কিয়োকো নিজেকে বন্দি মনে করে এই পুরুষশাসিত ব্যবস্থায়, এবং এটা আরো বেশি স্পষ্ট হয়, যখন দেখা যায় কিভাবে 'ডিরেক্টরের' থেকে একটা শাসনই তার আত্মবিশ্বাসে ভাটা এনে দেয়।
তবে এর বিপরীতে সোনো রেখেছেন নারীর 'সেক্সুয়াল ফ্রিডম'কে। এই থিমটি তার অন্যান্য কিছু সিনেমাতেও বিদ্যমান (যেমন, ২০১১ এর গিল্টি অফ রোমান্স)। এটি ছাড়া যেই স্বাধীনতা আরোপিত করা হয়েছে নারীদের প্রতি (বিশেষত জাপানি সমাজে, জাপানি নারীদের প্রতি) তা শুধুই ফাঁকা বুলি। এই স্বাধীনতা নিয়ে নারী সন্তুষ্ট থাকে, কিন্তু এই বুলি দিয়েই নারীদেরকে ক্যাটেগরাইজ করা হয় পবিত্র, বা দেহপসারিনী হিসেবে। এভাবেও একধরনের রেস্ট্রিকশনে বেঁধে ফেলা হয় নারীকে। তাই কিয়োকোকে বলতে শোনা যায় কিভাবে সে এই 'রেস্ট্রিকশন'কে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে এর মাধ্যমে স্বশক্তি অর্জন করতে চায়, কিভাবে নিজেকে দেহপসারিনীর স্থানে উত্তোলন করে তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে চায়। আর এই তথাকথিত 'পবিত্রতা' আর 'পতিতাবৃত্তি' এর মাঝে যারা আছে, যারা নিজেদের স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট, তারা যেন কুকুরঃ অন্ধভাবে প্রভুভক্ত।
একারণেই হয়তো নোরিকোকে কেন্দ্র করে যে যৌনদৃশ্য, সেটি বেশ 'ডিরোগেটরি' বলেই বোধ হতে থাকে। পক্ষান্তরে যেই নারী স্বেচ্ছায় তার 'জেন্ডার রোল' বাছাই করে নেয়, সে তুলনামূলকভাবে স্বাধীন।
যাইহোক, পর্নোগ্রাফির প্রতি এই 'ফেমিনিস্ট' মনোভাবটি যেন রমোঁ পর্নের সাধারণ চরিত্রায়ণগুলোর বিপরীত, যেখানে নারীদেরকে ভোগ্য এবং আকর্ষণীয় করে প্রদর্শন করাটাই মুখ্য, এবং নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে ক্ষমতায়ণ রয়েছে বলে মনে হলেও তা ক্ষ্ণস্থায়ী। এজন্য বেশি দূরে তাকাতে হয়না...আরেকটি রিবুট 'ওয়েট ওমেন ইন দ্য উইন্ড' এই এটি প্রতীয়মান। এই অন্যরকম ফেমিনিস্ট পর্নকে তুলে ধরার জন্য অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন সিওন সোনোকে। এভাবে ট্র্যাডিশনাল পুরুষধর্মী আর্টপর্নের স্ট্রাকচার কে ডিকন্সট্রাক্ট করেই বুঝি 'এন্টিপর্ন' - বিরুদ্ধপর্ন।
তবে সিনেমাতে যে 'ক্ষমতায়ণ' দেখানো হয়েছে তা কি সিনেমাটিতেই বাস্তবায়ণ হয়েছে? শেষ দৃশ্যে যে রঙের খেলা দেখা যায় - প্রজাপতির পাখার রঙে রঙিন, পরিপূর্ণ মুক্তি - তা কি বাস্তবিক, না শুধুই আরেকটা ইনার মনোলগ? সিনেমাটি নিজেও 'পুরুষদৃষ্টি' ( Male gaze ) থেকে মুক্ত নয়, অন্তত প্রথমদিকে। তবে সোনো যে তার কাজ নিয়ে আত্মসচেতন ও ক্রিটিক্যাল, তা নিয়ে নতুন করে পরিচয় দেওয়া বাহুল্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কি বলা যেতে পারে যে বোতলে বন্দি ক্যামেলিওন শুধু কিয়োকোর সীমাবদ্ধতাই নয়, বরং গল্পটারও সীমাবদ্ধতা?
সিনেমাটির পক্ষে-বিপক্ষে সবাই মেনে নিতে বাধ্য যে প্রত্যেক্টা দৃশ্য নান্দনিক, "অ্যাস্থেটিক্যালি প্লিজিং"। অসম্ভব সুন্দর আর্ট ডিরেকশন আর সুদক্ষ সিনেমাটোগ্রাফি, এই স্বল্প বাজেট, পুনরাবৃত্তিক সেটটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে (আর সোনোর কৌশলী ডিরেকশনে এই রুমটাকেই আমরা বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে বাধ্য, প্রতিবার নতুন একভাবে)। এছাড়াও সেটটাকে একটা খেলাঘর ভাব এনে দেয়, তাতে এই সিনেমাটিকে বেশি সিরিয়াসলি নেওয়া সম্ভব নয়। নিক্কাৎসু সফটকোরের যে স্বভাবসুলভ উচ্ছলতা, তাকে সিনেমার অন্তর্নিহিত মেসেজের বিনিময়ে বলি দেওয়া হয়নি। ক্লাসিক মিউজিকের মিনিমালিস্টিক ব্যবহারও আরেকটি শক্তিশালী পয়েন্ট।
'এন্টিপর্ন' জাপানি গোলাপি পর্দায় একটা নারীবাদী প্রতীক হতে পারে, বা হয়তো শুধুই বেশ ঘোলাটে একটা গল্প । তবে এই স্বল্প সময়ে ক্ষুদ্রপরিসরেও সোনো যে একইসাথে উদ্দেশ্য করেছেন জাপানি সমাজকে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে, আর নিজেকেও - তাতে আর কিছু না হোক, গল্পকার, বক্তা আর আর্টিস্ট হিসেবে সিওন সোনো যে অসামান্য, তা স্বীকার করে নিতেই হবে।
Comments
Post a Comment