জীবন যখন এক্সিস্টেনশিয়াল হরর

টাইটেল দিয়ে মিসইনফর্মেশন দিয়ে ফেলবো - তাই আগেভাগেই বলে রাখা ভালো, বর্তমানের অন্যতম সফল ইন্ডি ফিল্মমেকার ডেভিড লোয়ারি'র A Ghost Story (২০১৭) ভূতের গল্প নয় - এবং এরকম মার্কেটিং ও করা হয়নি বলেই আশা লোয়ারির, যদিও তার মতে, "আমি শিওর কোন একটা থিয়েটারে কেউ কেউ রেগেমেগে চিন্তা করছে, শুধু শুধু ১৫ ডলার খরচ করলাম হরর দেখবো মনে করে।"


  


গল্পের অনুপ্রেরণাটাও সরলঃ লোয়ারির স্ত্রী চাচ্ছিলের তারা লস এঞ্জেলেসে স্থানান্তর করবেন, কিন্তু তাদের টেক্সাসের বাসাটির প্রতি এক ধরনের মায়া জন্মে গিয়েছিল লোয়ারির। সেই সময়ে তিনি এক ধরনের এক্সিস্টেনশিয়াল ডিপ্রেশনের মধ্যেও ছিলেন, বলেন তিনি। এরপর রুনি মারা আর কেসি অ্যাফ্লেককে নিয়ে টেক্সাসে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শুট করে ফেলেন 'আ গোস্ট স্টোরি' ।

ফিল্মমেকার নিজে একজন এথিইস্ট, পরকালে বিশ্বাস নেই তার, বলেছেন তিনি - এসময় পৃথিবীতে নিজের সৃষ্টি ও অস্তিত্বের অস্থায়িত্ব ও তুচ্ছতার চিন্তা প্লাবিত করে সবাইকেই, বিশেষ করে আর্টিস্ট ও শিল্পস্রষ্টাদের। এই অনুভূতিকে তুলে ধরে এনেছেন ফিল্মমেকার অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে।

একাডেমিক রেশিওর ১.৩৩ঃ১ ফ্রেমে আবদ্ধ, এর কোণাগুলোতেও দেখা যায় ভিনিয়েট - খুবই স্পষ্টভাবে আমাদের মনে পড়তে বাধ্য যে আমরা এই ফিল্মের অংশ নই - এর দর্শকমাত্র। অনেকটা কিনেটোস্কোপে দেখা চিত্রগুলোর মত। কিন্তু খুবই ধৈর্য্যশীল্ভাবে সিনেমাটি আমাদেরকে নিয়ে যেতে থাকে প্রধান চরিত্র C এর পয়েন্ট-অফ-ভিউতে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে সবকিছুই চরিত্রদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, অনেকটা বাস্তব জীবনের মত।

সিনেমাটির পেসিং-ও কোন কোন দৃশ্যে খুবই স্থির - আবার যেখানে অন্যান্য চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে শটগুলোর ফ্রেমরেইট ২৪, সেখানে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে চলমান চরিত্রের জন্য শটগুলোর ফ্রেমরেইট ৩৩। যদিও শটগুলো একই দৃশ্য/সীনে অবস্থিত। এই সময়ের অসামঞ্জস্যতা আর নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চোখের সামনে চলে যেতে দেখা - এই দুইটি ব্যাপার মনে করিয়ে দেয় ডিপ্রেশনের সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ডিপার্সোনালাইজেশনের অবস্থাকে। একজন ডিপার্সোনালাইজড মানুষ নিজের জীবনের সাথে সংযোগহীন অনুভব করে, সময়ের সাথে সংযোগহীন অনুভব করে। আমরা দেখছি সি-এর দৃষ্টির মধ্য দিয়েঃ এই সংযোগহীনতা আমরাও অনুভব করতে পারি।


  


সিনেমাটিতে ফ্রেম-রেশিও ছাড়াও কালার প্যালেটের মাধ্যমে একটা নস্টালজিক ভাব তৈরি হয়েছে। অনেকাংশেই আমরা দেখি ৩০দশকের কালার ফিল্ম ফটোগ্রাফি অনুপ্রাণিত ঠান্ডা টোন ও সবজে টিন্টের কালার গ্রেডিং। এছাড়া জাম্পশটের বহুল ব্যবহার - যা সিনেমাটোগ্রাফার অ্যান্ড্রু পালের্মোর কাজে বেশ চোখে পড়ে। এই জাম্পশটগুলো এবং ম্যাচশটের সিমলেস ব্যবহারে বেশ নিখুঁতভাবে সময়ের ক্ষিপ্রতা ধরা পড়ে স্ক্রিনে।
কালার প্যালেটের কথা তুলে ধরলামঃ এই কালার প্যালেটের কন্টিনিউয়েশন কে ভঙ্গ করে, এবং পেসিংকে ভঙ্গ করার মাধ্যমে ফিল্মমেকার আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এই 'এলিয়েন' পরিবেশের সাথে যেখানে খাঁপ খাওয়ানো অসম্ভব আমাদের প্রোট্যাগোনিস্টের। যেমনঃ বাসায় নতুন বাসিন্দাদের আগমন, এবং ফিউচারিস্টিক (অফিস বিল্ডিং, শহরায়ণ) দৃশ্যগুলো।

সিনেমাটির প্রাথমিক স্ক্রিপ্টটি আরো বেশি ডায়ালগসমৃদ্ধ ছিলঃ যেখানে তুলে ধরা হয় পৃথিবীর সম্পূর্ণ ক্ষণস্থায়িত্বের এবং সৃষ্টির ক্ষণস্থায়িত্বের, ফলস্বরূপ শিল্পের স্থায়িত্বহীনতার - কিন্তু পরবর্তীতে ডায়ালগটি শুধু একটি দৃশ্যেই পূর্ণ করা হয়েছে - যার কারণে এই একটি দৃশ্য একটু বেশি ডায়ালগভর মনে হয়, কিন্তু সেটাকে মেনে নেওয়া যায় ফিল্মের অন্যান্য নুয়্যান্সের কথা চিন্তা করেঃ যেমন সময়ের চক্রাকার ঘূর্ণনে ফিরে আসা পাইওনিয়ার শিশুর কিছু একটা লেখা - যেটা আমরা কখনই জানতে পারিনা কি, এবং কালের বিচারে হয়তো এর কোন মূল্যও নেই ।




তেমনি মূল্য নেই হয়তো সি-এর তৈরি করা সুরের। কিন্তু এক অজানা মূহুর্তে আমরা দেখি গানটি শুনে কেউ একজন আশা অনুভব করে, সাহস পায় নিজের জীবনকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। এরকম মূহুর্তে আমরা দেখি রংধনুর আলোকচ্ছটার উপস্থিতি,  যা আবার দেখা যায় ফিল্মের শেষাংশেও - যেখানে আরেকটি নিঃসঙ্গ জীবন হারিয়ে গেছে হতাশায়, সেখানে গল্পটি শেষ হয় আশা দিয়ে। হয়তো তার সৃষ্টির মাধ্যমে সে কসমিক লেভেলে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেনি - বীটোভেনও পারবেননা। কিন্তু অন্তত একজন মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে গিয়েছে সৃষ্টিকর্ম। এই আশাহীনতার মধ্যেও আশার জাগরণের অ্যাবসার্ডিস্ট মেসেজটি এক্সিস্টেনশিয়াল ডিপ্রেশনের মাঝেও কিছুটা শক্তি যোগায়। এভাবে সিনেমাটি ফিল্মমেকারের জন্য যেমন কাথার্টিক একটি এক্সপিরিয়েন্স, তেমনি শিল্পীদের জন্যও ভরসার বাণীস্বরূপ।


সিনেমাটির সবচেয়ে চোখে পড়ার মতন জিনিসগুলো হলো (এর মনকাড়া কম্পোজিশন ছাড়াও) রুনি মারার অতিসূক্ষ্মভাবে ক্রমশ দৃঢ়তায় এগিয়ে যাওয়া অভিনয়। বিশেষকরে তার পাই খাওয়ার দৃশ্যটি। সিনেমাটির আর্টহাউজ পেসিং হয়তো সবার পছন্দ না হবে - সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু নির্জীবতা থেকে শোকে এগিয়ে যাওয়ার মূহুর্তগুলো খুবই শক্তিশালী। মারা সেটিকে অসাধারণভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন।

ড্যানিয়েল হার্টের অ্যাম্বিয়েন্ট মিউজিক সিনেমার ভাবগাম্ভীর্যকে খুবই সুন্দরভাবে কমপ্লিমেন্ট করেছে। বিশেষত শুরুতে ঘোর লাগানো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে ধীরগতির কসমিক দৃশ্যগুলো আমাকে Melancholia (২০১১) এর কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই ফিল্মটিও ভাবগতভাবে কিছুটা একইরকম।

Comments

Popular posts from this blog

The Eyes of My Mother: নারী, প্রকৃতি, বিচ্ছিন্নতা

রিভিউঃ Sala samobójców (2011)

চাইনিজ জেসমিন টি