কুকুরদাঁত

গ্রিক কিয়োনোদন্তাস  আক্ষরিক অর্থে কষদাঁত/ কেনাইনদাঁত/ ফ্যাং (ডগটিথ নামেও পরিচিত) - কুকুরের তো আছেই, মানুষেরও আছে। একপর্যায়ে কুকুরের ট্রেইনার বলেনঃ কুকুর হচ্ছে মাটির মতন - তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে গড়ে তোলার জন্য ট্রেইনিং দিতে হবে। ব্যাপারটা কি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?


দি শাইনিং, এনিওয়ান?

গ্রিক লেখক/পরিচালক ইয়োর্গোস লান্থিমোসের ২০০৯ এর ফিল্ম Κυνόδοντας (Dogtooth) এর প্রতিটি সীন বা দৃশ্যের কাফকায়েস্ক গল্প বলার ভঙ্গি থেকে অনেক ক্রিটিক তাকে মাইকেল হানিকির সাথে তুলনা করেন। সিনেমাটোগ্রাফার থিমিওস বাকাতাকিস তার আগের সিনেমা Kinetta (২০০৫)-তেও তার সাথে কাজ করেছেন - আর তার সফট কালার প্যালেট আর কিছুটা অন্যরকম ফ্রেমিং লান্থিমোসের সারিয়েল ধরনের গল্পটার সাথে মানিয়ে যায়ঃ যেন একটা মানুষ সোজা মুখে বলছে সে একজনকে খুন করেছে।

গল্পের পেসিং প্রায় পুরোটা ফিল্ম জুড়ে একইরকমঃ তাই আমরা জানিনা এরপর কি এক্সপেক্ট করতে হবে। সিনেমার একদম শুরুই হয় এক টেপরেকর্ডার থেকেঃ যেখানে তিনজন ভাইবোন শিখে যে 'সমুদ্র মানে একধরনের আর্মচেয়ার' ।


ডগটুথ সিনেমাটা দেখা একটা এক্সপিরিয়েন্স। এটা বুঝতে হলে সিনেমাটা নিজে দেখতে হবে। দেখার পর অবশ্যই চিন্তা আসবে - এর মানে কি??
যাইহোক, এর পরবর্তী পার্টগুলোতে স্পয়লার আছেঃ

সিনেমাটি অবশ্যই চিন্তাশীল বিষয় আছে অনেকগুলো। স্ট্রিক্ট প্যারেন্টিং এর কুপ্রভাব? মানুষকে কন্ট্রোল করার সীমা পরিসীমা? জ্ঞানের প্রভাব?

সিনেমা দেখার মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্নই আসতে পারে - বাবাটি এরকম হওয়ার পিছনে কারণ কি? তার উদ্দেশ্য কি? সত্যি বলতে সিনেমাটির একমাত্র নাম আছে এরকম চরিত্র ক্রিস্টিনা - আর তার কাজগুলো করার উদ্দেশ্য আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারিঃ সে অর্থাভাবে ভুগছে তাই সে পরিবারের বাবার কথামত চলতে বাধ্য। অন্যরা নামহীন এবং পুরোপুরি বাবাটির উপর নির্ভরশীল। তাদের নামও নেই - বড়,মেঝো ও ছোট নামে পরিচিত।

এসব প্রশ্নগুলোর উত্তর এই সিনেমাটির উদ্দেশ্য নয় এবং সেই দিক থেকে সিনেমাটি সফল। এর সেক্সুয়াল দৃশ্যগুলোও দেখতে বেশ নিরস এবং অনেক ক্ষেত্রে বেশ অস্বস্তিকর। এখানেও কিছু অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়ঃ ছেলেটির যৌনচাহিদা পূরণের জন্য অফিসের দারোয়ানকে ভাড়া করা হয়, কিন্তু মেয়েদের কথা এখানে চিন্তা করা হয়না। আবার ছেলেটির যৌনচাহিদা পূরণের বয়স হলেও, তার আচরণ দেখে মনে হতে বাধ্য, তার মানসিক বয়স এখনো শিশুকালেই পড়ে আছে।

এর কোন কোন শট বেশ সিমেট্রিক্যাল, আবার কোন কোন শটে বেসামাল ক্রপিং ( কনুই, হাঁটু, জয়েন্ট ইত্যাদি) - এই ব্যাপারগুলো সিনেমার ব্ল্যাক কমেডি ভাইবকে পূর্ণতা দেয়। কিছু কিছু ডায়ালগ এত অ্যাবসার্ড যে কমেডিক একটা ব্যাপারের মাধ্যমে ডিরেক্টর সিনেমাটির অন্ধকার ভাইবকে আড়াল করে রাখেনঃ 'কান্ট মানে একধরনের বড় ল্যাম্প' বা অ্যানিভার্সারি অনুষ্ঠানে গিটারের অ্যাক্যুস্টিক সুরের সাথে বড় মেয়েটি Flashdance (১৯৮৩) এর একটি কোরিওগ্রাফিতে নাচতে। অথবা, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার Fly Me To The Moon গানটিকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করতে।




আমরা দেখি তারা সময় পার করার জন্য অনেক কাজ করে যেগুলো ক্ষতিকর না হলেও ক্ষতি করার সম্ভাবনা আছে (গরম পানির নিচে আঙুল রাখা, ক্লোরোফর্ম নেওয়া ইত্যাদি)। এবং তাদের মানসিক অবস্থাঃ কিভাবে ভাবলেশহীনভাবে কেঁচি দিয়ে কেটে ফেলে পুতুলকে, বা ছুড়ি দিয়ে আরেকজনকে। তাদের বাসা দেখে মনে হতে বাধ্য যে তারা বেশ ধনাঢ্য। কিন্তু তাদের 'ট্রেইনিং' অনেকটা কুকুরের ট্রেইনিং এর মতই (আক্ষরিক আর ভাবগত দুইভাবেই)। আমার কাছে ইন্টেরেস্টিং মনে হয়েছে সিনেমার এক পর্যায়ে কুকুরের ট্রেইনিং ফ্যাসিলিটি দেখানো যেখানে কুকুরকে বশে আনতে তাকে আচ্ছামতন পেটানো হয়। আবার আমরা দেখি বাবা ও মা ছেলে-মেয়েরা তাদের অবাধ্য হলে ভয়ানকভাবে মারধোর করতে।

আবার ছেলেটি অনেক প্রতিভাবান - কিন্তু তার প্রতিভাগুলো সে পরিবারের কাজেই লাগায়, ছোট মেয়েটি অনেক জ্ঞানী - সে অ্যানাটমির অনেক জ্ঞান রাখে আর এগুলো তার ভাইবোনকে শেখায়। কিন্তু এগুলো সত্ত্বেও তারা বাবার আদেশের উপর নির্ভরশীল। এক মূহুর্তের জন্যেও তারা বাড়ির বাইরে পা রাখেনা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও না। এমনকি অ্যানাটমির জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ছোট মেয়েটি চিন্তা করেনা যে মানুষের কুকুর জন্ম দেওয়া সম্ভব কিনা।

কিন্তু একসময় বড় মেয়েটি তার পাওয়া হলিউড মুভির দুইটি টেপ ( Rocky , Jaws ) থেকে পায় বাইরের পৃথিবীর স্বাদ। এভাবে সে বিদ্রোহী হয়ে যায়। নিজের জন্য একটা নাম  ঠিক করে (ব্রুস)। এখানে এক ধরনের আইডেন্টিটি লাভ করার সাথে সাথে সে বাইরে যাওয়ার প্রতি বা স্বাধীনতার প্রতি একধরনের আকর্ষণ অনুভব করে?




সিনেমাটি দেখার সময় নেচার ভার্সাস নার্চার বিষয়ে একটা প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা দেখি যে বড় মেয়েটি বাইরে যাওয়ার প্রতি এক ধরনের আগ্রহ তৈরি করছে। কিন্তু তাদেরকে বলা হয়েছে যে একমাত্র কষদাঁত পড়ে গেলেই তারা যেতে পারবে বাইরে ( কষদাঁত তো বেশ শক্ত, মানে ভালোমতনই দড়ি বাঁধা তাদের গলায় )। তাই বাইরে যাওয়ার তীব্র তাড়নায় 'ব্রুস' তার দাঁত ভেঙে ফেলে।

আবার দেখা যায়, কিভাবে এই 'বিদ্রোহ' একটা সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি করে - বাবা, যে নাকি সবসময় বলে আসছেন যে গাড়ি ছাড়া বাহিরে বের হওয়া যাবেনা, এবং নিজেও কখনো বাইরে বের হননি গাড়ি ছাড়া, তিনি চিন্তায় বিহ্বল হয়ে গাড়ি ছাড়াই বাইরে ছুঁটে যান। পুরো সিনেমাটিতে তিনি সম্পূর্ণ কন্ট্রোলে ছিলেন কিন্তু এখন পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।

সিনেমার মাধ্যমে বড় মেয়েটি যে বাইরের জ্ঞান পায় তার মাধ্যমে সে বিদ্রোহের ভাষাও পায় - যেমন আমরা দেখি ছেলেটির ক্ষেত্রে ক্রিস্টিনার অভাব বড়বোনকে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করা হয়, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে - যা সে মেনে নেয় ঠিকই, কিন্তু এরপরে সে তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে 'রকি' সিনেমাটির কিছু আক্রমণাত্মক ডায়ালগ (পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সিনেমার ক্ষমতা?) । নিজের অনিচ্ছা ও ক্ষোভ যেটা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারেনা তা সিনেমার ভাষায় প্রকাশ করার সুযোগ পায় সে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য অ্যাক্ট ছিল বিড়ালের বিষয়টি। আমরা দেখি বিড়ালটিকে কি সহজভাবে খুন করে ফেলার দৃশ্য। কুকুর-বিড়ালের মধ্যকার চিরকালীন শত্রুতার একটা ধারণা আছে যেটা এখানে রেফারেন্স করা হয়েছে। যদিও সাদা চোখে দেখা যায় বিড়ালটি আকারে কত ক্ষুদ্র আর নিরীহ। অথচ এখানে মূল ভিলেইন হয়ে গিয়েছে বিড়াল প্রজাতি। মানুষ যা জানেনা তাকে নেতিবাচক হিসেবে প্রকাশ করা এবং সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে যে একটা 'জুজুর ভয়' তৈরি করার টেন্ডেন্সি মানুষের মধ্যে আছেঃ তাতে কোন সন্দেহ নেই, এখানে শুধু আরেকবার উঠে আসে পর্দায়।


সিনেমাটিতে সময়কে ছাপিয়ে যাওয়ার (টাইমলেস) এক ভাব আছে। হলিউড টেপগুলো সব আশির দশকের, কিন্তু সময় পার হওয়ার ব্যাপারটা বোধগম্য হয়না। এই নামহীন, সময়হীন ভাবটিতে রিসেন্ট Eyes of My Mother (২০১৬) এর কথা মনে পড়ে গেল।

সিনেমার দুইটি জিনিস বেশ ভালো লেগেছেঃ কিছু সূক্ষ্ম ডিটেইলের প্রতি লান্থিমোসের মনোযোগ - খেয়াল করে পানির বোতল থেকে লেবেল্গুলো কেটে ফেলা। আর কোন মূহুর্তে সিনেমাটিকে বেশি সিরিয়াস হতে না দেওয়া। শেষ মূহুর্তেও যখন সবাই বড়মেয়েটির খোঁজে বিহ্বল, তখন পরিবারের অন্যসবার কুকুরের মত আচরণ করা। তবে হ্যা - সিনেমাটি সেইসব সারিয়েলিস্ট সিনেমাগুলোর মত এর শেষটাকে ধোঁয়াশাতে রেখে দেয়। এর একমাত্র তুলনামূলক দীর্ঘতম স্টিলশট গাড়ির বুটে। এখানেও ডিরেক্টর আমাদের এক্সপেক্টেশনকে ঝুলিয়ে রাখেন। মেয়েটি কি বের হবে নাকি হবেনা?

এভাবে, সিকোয়েন্সগুলো প্রত্যেকটাই অদ্ভূত - লান্থিমোস কোন সিকোয়েন্সেই স্টেপ মিস করেননা। আর যেকোন শট যতই লোমহর্ষক হোক না কেন (আহেম, বিড়ালের অন্ত্র) - স্ক্রিনের দিকে চোখ আটকে থাকতে বাধ্য। ডগটুথ মডার্ন সারিয়েলিজমের ক্ষেত্রে লুইস বুইনুয়েল না হোক, অবশ্যই একটা 'কামড়' (cringey pun alert! স্যরি দেরি হয়ে গেছে মনে হয়... ) 

Comments

Popular posts from this blog

The Eyes of My Mother: নারী, প্রকৃতি, বিচ্ছিন্নতা

রিভিউঃ Sala samobójców (2011)

চাইনিজ জেসমিন টি