It Comes At Night: মৃত্যুর মুখে মানবতা
পৃথিবীর শেষ ব্যাপারটা কেমন হবে? অ্যাপোক্যালিপ্স বলতে এখনও মানবসমাজেরই শেষ বোঝানো হয় - কিন্তু তখন কেমন হতে পারে? এই প্রশ্ন নিয়ে আর্টিস্টদের চারণার শেষ নেই। সেটা কেমন হতে পারে? তখন মানুষ কেমন হতে পারে? Mad Max Fury Road (২০১৫) এর তেলের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতা ব্যবস্থা, The Road (২০০৯) এর জীবনের মৌলিক উপাদান খুঁজে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, না 28 Days Later (২০০১) এর জম্বি থেকে পালিয়ে থাকা? তখন মানুষের সাইকোলজিক্যাল অবস্থা কেমন হতে পারে?
Krisha (২০১৫) খ্যাত লেখক-ডিরেক্টর ট্রেই এডওয়ার্ড শুলজ তার দ্বিতীয় ফিচার It Comes At Night (২০১৭) এর জন্য অনুপ্রেরণা নেন কার্পেন্টারের The Thing, কুব্রিকের The Shining আর রোমেরোর Night of The Living Dead এর মত হরর ক্লাসিকগুলো থেকে - যদিও তিনি এই ফিল্মটিকে হরর ফিল্ম হিসেবে দেখেন না। এইসব ক্লাসিকগুলোতে বিপদের মুখে কিভাবে ভয় থেকে অবিশ্বাস ও প্যারানয়া মানুষকে পরিবর্তন করে ফেলে - এই বিষয়টি তাকে আকর্ষিত করে, বলেছেন শুলজ। মানুষের নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার যে চেষ্টা, ভূত/এলিয়েন বা অভূতপূর্ব বিপদের থেকে নিজেকে বা নিজের পরিবারকে শক্তিশালী প্রমাণের চেষ্টা দেখা যায় এই সিনেমাগুলোতে । কিন্তু কি হয় যদি এই পাওয়ার স্ট্রাগল হয় দুইটি পরিবারের মধ্যে?
এরূপ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা যায় উইলিয়াম গোল্ডিং এর অমূল্য ক্লাসিক Lord of the Flies-এ। যেখানে আমরা দেখি একটি বিচ্ছিন্ন একক সমাজে বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেকে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, যেখানে ক্ষতিগ্রস্থ হয় নিরপরাধ সঙ্গীরা। এই বইটিও সিনেমাটির পিছনে আরেকটি অনুপ্রেরণা। সিনেমার শুরুর দিকে দেখা যায় ব্রুগেল এর এই পেইন্টিংটিঃ দি ট্রাইউম্ফ অফ ডেথ (১৫৬২) - যেটি ব্রুগেল সৃষ্টি করেছিলেন ইউরোপের বিউবনিক প্লেগ এর সময়ে। বিশেষ করে ক্রস-কাটে দেখানো হয় একাংশ যেখানে কঙ্কালগুলোর সাথে কিছু মানুষ যুদ্ধ্যদত; এবং কোণায় যেখানে খাওয়ার আসর ভেঙে গিয়েছে এবং কিছু মানুষ কঙ্কালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ার পথে। শুলজের বাসায় ব্রুগেলের পেইন্টিং গুলো ছিল যা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে - এ থেকে তার সিনেমাগুলোতে ব্রুগেলের উপস্থিতি দেখা যায়।
ছবিটি সিনেমার পরবর্তী গল্পের দিকে নির্দেশ করে থাকে, যা আমরা এর চমৎকার ওপেনিং সীনে দেখি, কিভাবে ধাপে ধাপে এক অসুস্থ, কিন্তু অতি সাধারণ বৃদ্ধ থেকে গ্যাসমাস্ক পড়া এক পরিবার - এরপর তাকে পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য। আমরা চিন্তা করতে থাকি এই নামহীন 'অসুখ'টির ভয়াবহতা এবং এই পরিবারের আগের অভিজ্ঞতা যার কারণে বুড়োটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে মেরে ফেলা বেশি সহজ।
টেরেন্স মালিকের অধীনে শুলজ কাজ করেছিলেন, তার ছাপ পাওয়া যায় এখানে। পেসিং অনেক স্থির, ধৈর্য্যশীল। সিনেমায় টানেল-ভিশনের উপস্থিতি প্রচন্ড; গল্পটির ফোকাস ছাড়া অন্য কোন দিকে মন দেননি লেখকঃ যেটি হচ্ছে গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে উত্তোরোত্তরভাবে বাড়ন্ত অবিশ্বাস। গল্পটির প্রধান চরিত্র হল প্রথম পরিবারের বাবা পলঃ তার নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তেই এগোয় কাহিনী; কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র হল ট্র্যাভিস। ডিরেক্টর নিজেও সেটি বলেছেনঃ বেশিরভাগ ঘটনা আমরা দেখি ট্র্যাভিসের দৃষ্টি থেকে। এখানে ক্যামেরার মাধ্যমে গল্প বলার অনেকগুলো দিক চোখে পড়ে।
ট্র্যাভিসের রাতে দুঃস্বপ্ন দেখার সমস্যা আছে, যেই কারণে শুধু চরিত্রগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয় তা নয়, তৈরি হয় দর্শক ও ট্র্যাভিসের মধ্যে। বিশেষ করে শেষাংশে - যে কারণে বাস্তবতার ভয়াবহতাকে এক মূহুর্তের জন্য মনে হবে এটাও হয়তো আরেকটি স্বপ্ন; যদিও সত্যিটা জানতে তেমন সময় লাগেনা। এছাড়াও ট্র্যাভিসকে ফোকাস করা দৃশ্যগুলো হয় দীর্ঘ পেসের ক্লোজাপ-শট - আমরা যেন তার দুঃখবোধের সাথে সিম্প্যাথাইজ করতে পারি; আর যেগুলো ওয়াইড-অ্যাংগল (মূলতঃ তার আলো হাতে পায়চারি করার সিকোয়েন্স) সেগুলোও প্রায় পুরোটা ছায়া দিয়ে ঢেকে এর পরিসর খুব সীমিত করে ফেলা হয়েছেঃ এই বিশালতা যেমন তার একাকীত্বকে স্পষ্ট করে তোলে, তেমনি আমরা একটা ভাব পেতে পারি যে সে এখানে বন্দি আর আবদ্ধ অনুভব করে। করাটাই স্বাভাবিকঃ তার জীবন সাধারণ ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের মতন নয়। নিজের মধ্যে তার সময় কাটেঃ আমরা দেখি যে সে তার বাবামা'র সাথে কথা বলেনা - তার কথা বলার সাথী একমাত্র তার কুকুর - সত্যি বলতে আরেকজন মানুষ যার সাথে তার খোলাখুলিভাবে কথা বলতে দেখা যায় তা হচ্ছে কিম।
এখানে কিমের ক্ষেত্রেও তার একধরনের গোপন অভিসার কাজ করে। হয়তো ট্র্যাভিসের জন্য অনেক দীর্ঘ সময়ে দেখা এটি একজন মেয়ে যে তার সাথে তুলনামূলক সবচেয়ে কাছাকাছি বয়সের, হয়তো এখানে দায়ী গোপনে কিম ও উইলের উপর স্পাই করা - যার মাধ্যমে সে অনুভব করতে পারে এমন এক জীবনের যা সে দেখেনি; যেখানে আনন্দ আর হাসি আছে। উইল-কিম দম্পতি এবং পল-সারাহ দম্পতির একান্ত মূহুর্তগুলো পাশাপাশি দেখানোর মাধ্যমে খুবই স্পষ্টভাবে এই পার্থক্যটা বোঝানো হয়।
শুল্জ্ গল্পটি লেখার প্রধান ইন্সপায়ারেশন বলেন তার বাবার সাথে তার সম্পর্কঃ যেটি ভালো ছিলোনা এবং তাদের মধ্যে বেশ বড় এক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এই বাবা-ছেলে সম্পর্কের টানাপোড়েনও এখানে দেখতে পাই। প্রথমাংশে ট্র্যাভিসের পাশে তাদের যে ফ্যামিলি পোর্ট্রেইট থাকে সেখানে তাদের তিনজনের মধ্যে ট্র্যাভিস আর পলের মধ্যে বেশ দূরত্ব দেখা যায় (সেই সাথে গায়ের রঙের একটা ব্যাপার আছে...); তাদের মধ্যকার ইন্টার্যাকশনও বেশ সন্ত্রস্ত, স্ট্রেইন্ড। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা জাগে যে হয়তো পল ট্র্যাভিসের বায়োলজিক্যাল বাবা না। কিন্তু পল-কে চেষ্টা করতে দেখা যায় সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। পক্ষান্তরে উইল এসে অল্পদিনের মধ্যেই ট্র্যাভিসের সাথে একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে - যা পলের মধ্যে কিছুটা ঈর্ষা তৈরি করবে স্বভাবত।
আলো-ছায়ার মাধ্যমে সিনেমাটিতে সেন্স-অফ-স্পেস কে ম্যানিপুলেট করার একটা দিকের কথা বলেছি। বিশেষ করে ঘরের মধ্যে বেশ চাপা করিডর ছাড়াও হলরুমে বা বাড়ির বাইরেও আলো-ছায়ার ব্যবহারে এক ধরনের পরিবেশ তৈরি হয় - বেশ আবদ্ধ, ক্লস্ট্রোফোবিক। এছাড়াও উইলের সাথে পল যখন যায় তখন আমরা দেখি অনেক সহজভাবে গাড়ির পেছন থেকে হাতুড়ি বের করে নিতে পল-কে, উইল যেন কোনভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে সেই সুযোগগুলো কেড়ে নেওয়া; আবার যখন সে রিয়ারভিউ মিররে দেখার চেষ্টা করে তখন দেখা যায় তার চেহারা (বেশ সুবিধাজনকভাবে) গাছের ছায়া দিয়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে - তার এক্সপ্রেশন বোঝা দুষ্কর।
সিনেমার যেই বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে ইন্টেরেস্টিং মনে হয়েছে তা হলোঃ সাধারণ হরর ট্রোপের কিছু বিপরীত ইলিমেন্ট ব্যবহার। যদিও এই 'তারা' আসতে পারে রাতে এই চিন্তা নিয়ে সব সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে কিন্তু সিনেমার কনফ্রন্টেশনগুলো প্রায় সবগুলোই দেখা যায় দিনে সঙ্ঘটিত হয় (দুইটি ছাড়া) যা দেখা যায় Jaws(১৯৭৫) ও Texas Chainsaw Massacre (১৯৭৪) এ-ও কিন্তু ডায়ালগগুলোর অবস্থান ছিল রাতে, যেগুলোই মূলতঃ চরিত্রগুলোর সম্পর্কের ভিত পরিবর্তন করতে থাকে ধীরে ধীরে। এভাবে আমাদের এক্সপেক্টেশনকে ব্যবহার করে ডিরেক্টর তার পয়েন্ট তৈরি করতে বেশ সক্ষম হয়েছেন।
সিনেমাটির আরেকটি প্রধান ইলিমেন্ট হলো এর লাল দরজা। লাল স্বাভাবিক বিপদ, সাবধানতার রং। দিনের বেলায় এই দরজাটিকে আমরা কখনো দেখিনা (কিন্তু এটি সেখানে আছে)। আমার মনে হয়েছে এটি চরিত্রগুলোর প্রধান এক ভয়ের প্রতিনিধিত্ব করছেঃ তা হল মৃত্যুর ভয়, এই অজানা অসুখে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার ভয়, বাইরে কি আছে বা থাকতে পারে তার ভয়। এই অজ্ঞাত বিষয়ের ভীতি সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে প্রথম - আর সবচেয়ে আকস্মিক আর অজ্ঞাত বিষয় হলো মৃত্যু। এই বিষয়টিও ফিল্মমেকারটির আরেকটি অনুপ্রেরণা।
সিনেমাটিতে অস্পষ্টতার ভাব অনেক বেশি। যেগুলো অনেক সময় বেশ ইন্টেরেস্টিং কিছু পয়েন্ট তৈরি করে। আমরা কিছুটা ডায়ালগ শুনে বুঝতে পারি আরেকটি পরিবারের ছোট শিশু (হয়তো) আক্রান্ত। কিন্তু সত্যি বলতে আমরা শিশুটিকে আর সামনাসামনি দেখিনা। আসলেই কি সে আক্রান্ত না ট্র্যাভিস ভুল বুঝছে? এরকম একটা প্রশ্ন আমাদের সামনে রেখেছেন গল্পকার। তবে ওভারঅল বলা যায় উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই বেশি, যা অনেক দর্শকের জন্য বেশ বিরক্তির সৃষ্টি করে। আসলেই কি উইল মিথ্যা বলছিল? দরজাটা আসলে কিভাবে খুলে গিয়েছিল? এই অসুখের আসল রূপটি কি? ট্র্যাভিস কি আসলেই ইনফেক্টেড হয়েছিল? ইত্যাদি।
তবে এই বিষয়গুলো আমার জন্য বিরক্তি তৈরি করেনি বরং গল্পকারের আসল প্রশ্নের দিকে দৃষ্টি রাখলে চিন্তা করার মত বিষয়ের অভাব নেইঃ "সমাজ যখন ভেঙে পড়ে তখন কি হয়? মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর কি হতে পারে? নিজের মনুষ্যত্বকে হারিয়ে ফেলা?" যখন পল আদেশের স্বরে বলে নিজের পরিবারের বাইরে কোন মানুষকে বিশ্বাস না করতে, সেটা কি খুন করার জন্য আদর্শ জাস্টিফিকেশন হতে পারে? একটা মানুষের ভয় ও প্যারানয়া, সেটা বেঁচে থাকা হোক, বা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য হোক, ট্র্যাভিসের মত শান্ত-উদারমনের মানুষও স্বপ্নকে 'প্রিমনিশন' মনে করে নিজের স্বভাববিরুদ্ধ এক কাজ করে বসে।
সবশেষে আমি বলবো, It Comes At Night এক দক্ষ লেখকের তৈরি প্রশ্নবোধক এক গল্প, এবং এক ট্যালেন্টেড ফিল্মমেকারের একটা উল্লেখযোগ্য কাজ। এই সিনেমাটি আরো পূর্ণতা না পাওয়ার একটি কারণ হবে এর এন্ডিং এর খুব দ্রুতভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার একটা অনুভূতি, এবং এর স্বল্প দৈর্ঘ্যের কারণে এর মধ্যকার থিমগুলোকে আরো গভীরতা না দেওয়া। আর আরেকটি সত্যি কথা হলো এই সিনেমাটি আশানুরূপ দর্শক রেটিং না পাওয়ার প্রধান একটা কারণ হলো একে হরর হিসেবে মার্কেটিং করা, আর এক্সিস্টেনশিয়াল হরর সাধারণ মার্কেটের ক্যাটেগরিতে পড়েনা।
Comments
Post a Comment