ঝড়ে পড়ে যাওয়া পাখি আর মাইক্রোস্টোরি সমস্যা

[ spoilers ]

কোনরকম কষ্টে মষ্টে কিশোর বয়সটা পার করতে পারলেই হলো; কেউ বলবে সেটা ছিলো তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, কেউ বলবে কৈশোরকালের নানা অপাওয়ার কথা। তবে যাইহোক, সেই সময়টার রহস্যগুলোই তাড়া করে ফিরে আমাদের ইনার-টিনেজারকে। এরকম থিমটাই মূল উপজীব্য লরা সাসিশ্‌কে এর বই White Bird in a Blizzard - এ। যার উপর ভিত্তি করে গ্রেগ আরাকির ২০১৪ এর ফিল্ম, একই নামে। 



ইন্ডি ফিল্মমেকার হিসেবে আরাকি এক কথায় অসামান্য। তার ফিল্মে নিহিলিজম, অ্যাপেথি, সেক্‌শুয়ালিটি এরকম ব্যাপারগুলো তিনি খুব সামনাসামনি ভাবে তুলে ধরেন। এক কথায় বোল্ড। মিলেনিয়াল টিনেজ ব্যাপারগুলো এজন্য তার চেয়ে ভালো করে তুলে ধরার মতন মানুষ কমই আছে, বলা যায়। তার ফিল্মের কালার গ্রেডিং থেকে শুরু করে ক্যারেক্টার শট গুলাতে একধরনের রক-অ্যান্ড-রোল, ফ্যান্টাসি ভাব ফুঁটে উঠে থাকতে দেখা যায়। 

এই থিমগুলো হোয়াইট বার্ড-এ ও কন্টিনিউড। তবে তার অন্যান্য ফিল্মগুলো থেকে এটা কিছুটা ভিন্ন। আপাতদৃষ্ট শর্ট টার্ম কাজ-কারবার ছাড়াও, সর্বসাপেক্ষে আরেকটা বড় থিম নিয়ে আলোচনা রয়েছে এই ফিল্মটিতে। 'আম্ব্রেলা আইডিয়া' ব্যাপারটা হলো এখানে এরকমঃ ক্যাট কনারের মা ইভ একদিন হঠাৎ করে নামনিশানাহীন ভাবে উধাও হয়ে যায়।  বিভিন্ন কারণে তার বাবাকে সন্দেহ করা হয়; ক্যাট সন্দেহ করে যে তার মা-ই হয়তো স্বেচ্ছা-ই চলে গিয়েছে তাদের ছেড়ে। 


পুরো ঘটনাটা নিয়ে সে যথেষ্ট অপ্রভাবিতভাবেই হাইস্কুলজীবন পার করে দেয়; যদিও সাবকনশাসে তার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এই কাহিনী দ্বারাই প্রভাবিত হবে একভাবে,  তাইনা? ব্যাপারটা ঠিক তেমন না । মায়ের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে তার মনোভাব আমরা প্রধানত দেখতে পাই তার থেরাপিস্টের সাথে তার ইন্টার‍্যাকশনের মাধ্যমে। 

এটি ছাড়া তার জীবন অন্যান্য সাবার্বান টিনেজারদের মতনইঃ সেক্স, পার্টি, এবং সাবার্বান কোলাহলহীন জীবনের প্রতি নস্টালজিয়া, আবার ঘৃণা। এমনকি যেই ব্যাপারটাকে আপাতদৃষ্টিতে ক্যাটের প্রমিস্কুয়াসনেস বলা যায়, সেটা মূলতঃ অনেক টিনেজ মেয়েদেরই ফ্যান্টাসি (যা ক্যাটের বান্ধবী বেথের কমেন্ট থেকেই বোঝা যায়)। অর্থাৎ এখানে তার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত মূলতঃ স্বেচ্ছায় চলা এক টিনেজারেরই বৈশিষ্ট্য। 

এছাড়া ক্যাটের উপর ঘটনার প্রভাবহীনতা বোঝা যায়, যখন সে চিন্তাহীনভাবেই মেনে নেয় তার বাবার নতুন প্রেমিকাকে। তার নিজের নতুন প্রেমিকের অপছন্দ সত্ত্বেও ধূমপান চালিয়ে যেতে থাকে। সেই সাথে ঘটনার পিছনে ক্যাটের ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়তে থাকে তার মায়ের সাথে তার স্ট্রেইন্ড রিলেশনশিপঃ যার ঘনত্ব কমছিলো বই, বাড়ছিল না। এক সময়ে সে সন্দেহ করতে থাকে হয়তো তার মায়ের আরেকটি অ্যাফেয়ার চলছিল। জটিল পারিবারিক জীবন এক কথায়। ব্যাপারটা আসলেই এক কিশোরীকে কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই থিমটি নিয়ে আরো গভীর আলোচনা করা যেতো; তা হয়নি অবশ্য। কেন?


কারণ হিসেবে বলবো আমি যে আরাকির শোও-ডোন্ট-টেল থিওরিটার প্রতি আনুগত্যঃ তিনি সবকিছু স্ক্রিনেই দেখাতে পছন্দ করেন; সেই সাথে ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজমের প্রতি তার একধরণের টান আছে।দুইটি মিলিয়ে তিনি সম্পূর্ণ ঘটনার আসল উত্তরটি আমাদের ফিল্মের শুরু থেকে দেখিয়ে এসে যাচ্ছিলেন।  এখানে থেকে দৃষ্টি এক দিকেঃ তা হলো ইভের হারিয়ে যাওয়ার আসল রহস্য; অপর দিকে এক কনফিউজড কিশোরী থেকে তরূণে পরিণত হওয়া ক্যাটের জীবন। দুইটি ব্যাপার একসাথে এগিয়ে যেতে পারতো - কিন্তু ফিল্মটিতে পুরোটা সময়ে মনে হয়েছে যে এই দুইটি আর্ক সমান্তরালভাবে চলেছে। 
শো-ডোন্ট-টেল নিয়ে আরেকটি বিষয়ঃ সেটি হলো,  বিভিন্ন ঘটনা - যার অনেকগুলোই ক্যাটের দেখা, আর অনেকগুলোই তার চিন্তাপ্রসূত - এগুলোর মাধ্যমে আমাদের মনে একটা ধারণা স্থায়ী হয়ে পড়ে ইভের পরকীয়ার ব্যাপারে। অথচ আসল ঘটনাটি সম্পূর্ণ উলটো।  

তাই, শেষে এসে আমরা যখন উত্তর পাই পুরোটা রহস্যের তখন আমাদের একটি কৌতুহলের সমাপ্তি হয়, কিন্তু এটুক পর্যন্তই। এবং ক্যাটের সাথে ঘটনাটার একমাত্র যোগসূত্র শুধু ক্যাটের স্বপ্নগুলোই। তবে এ কারণে শেষ দৃশ্যে যখন ক্যাট নিজেকে বলে যে, এখনো তার মনে হয় তার মা'র সাথে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাবে তখন তার এই ধারণাকে বিশ্বাস করে ফেলা যায় - এটিই আরাকির গল্পবলার স্বার্থকতা। 

আমার পার্সোনালি মনে হয়েছে, কাহিনীর টুইস্টটির আবির্ভাব হঠাৎ করে, কোনরকম হিন্ট বা কারণ ছাড়াই, বরং বলা যায় এর একমাত্র প্রমাণ ডিটেক্টিভের উক্তিতে, সেই সিদ্ধান্তেও আসা হয়েছে এই কারণে যে আর কোন প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। 

আরেকটি প্লটহোল নিয়ে আমার অভিযোগঃ একটা ফোনকলের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, ক্যাটের বাবা পুলিশের ট্রুথ টেস্টে পাস করে গিয়েছেন - যার কারণে মনে হতে পারে যে উনি আসলে সোশিওপ্যাথ, অথচ কাহিনীর টুইস্টের মুহূর্তে তার মনোভাব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে আসলে সাইকোপ্যাথ, বা অনুরূপ, অর্থাৎ প্যাথলজিক্যাল লায়ার হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এই দুইটি পয়েন্ট হয়তো স্ক্রিনপ্লেই স্রষ্টার চেয়ে লেখিকার উপর পড়ে। 



ফিল্মের কালার গ্রেডিং বলেছিঃ এক্ষেত্রে ডাইরেক্টর হিসেবে শ্রেষ্ঠ না হলেও অন্তত তুখোড় তো বটেই, আরাকি। গল্পটিকে সুন্দরভাবে আগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে প্রতিটি কম্পোসিজনই। ক্ষেত্রবিশেষে নিওন এবং অধিকাংশ সময়ে প্যাস্টেল এবং সফট প্যালেটে আশির দশকের ভাব প্রকাশ সিদ্ধান্ত পার্ফেক্ট (এক্ষেত্রে আমার অ্যাড্রিয়ান লিনের '৯৭ এর ফিল্ম 'ললিটা'র কথা মনে পড়ে গেল )।

 বিভিন্ন ট্র্যাডিশনাল শট অনেক ভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এখানে; কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে মাস্টার-শট আছে, বিশেষ করে শেষের দিকে একটির কথা মনে পড়ে গেল যেখানে ক্যাট তার বাবাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। মডারেট গতিতে প্রতিটি কম্পোজিশন এগিয়ে চলে, এখানে ফাস্ট-মোশন শট নেই (আরাকির অন্যতম বৈশিষ্ট্য)। 
একটি গুরুত্বপূর্ণ লং-হোল্ডিং টু-শট আছে (উপরের স্ক্রিনক্যাপ দ্রষ্টব্য) - এখানে হঠাৎ পরিবারের একজন হারিয়ে যাওয়ার পরে দুইজনের মধ্যে যে গ্যাপ তা এখানে নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে - আর আমরাও বুঝতে পারি যে ক্যাট এবং তার বাবা ব্রকের মধ্যে দূরত্বটা একটু বেশিই।

আরেকটি ব্যাপার হলো ফিল্মটির মূল স্বার্থকতা এর অ্যাক্টর-ড্রিভেন ইলিমেন্টের জন্য (চরিত্র বা গল্প দ্বারা চালিত নয়), অর্থাৎ মূলতঃ কিছু অসামান্য কাস্টিং এর জন্য গল্পের কিছু ব্ল্যান্ড দিকগুলোও সুন্দরভাবে ফুঁটে উঠেছে। আরেকটু স্পেসিফিকভাবে বলতেঃ ক্যাট হিসেবে শেইলিন উডলি, যাকে এই ফিল্মে ভাবলেশহীন স্বেচ্ছাচারী তরুণী হিসেবে মানিয়ে গিয়েছে, আর, মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, ইভ কনার হিসেবে ইভা গ্রিন; নিজের হারানো যৌবন নিয়ে হতাশাগ্রস্থ মা হিসেবে তিনি অসাধারণ। মূলতঃ ইভকে আমরা দেখতে পাই ক্যাটের দৃষ্টি থেকে, যা হয়তো সত্যি, হয়তো না। কিন্তু কিছুটা মানসিকভাবে আক্রান্ত, অথচ স্নেহশীল - এই দুইটি কন্ট্রাস্টিং ক্যারেক্টার সফলভাবে তুলে ধরতে পারেন ইভা, এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।


অন্যান্য ক্যারেক্টারগুলো গল্প আগানোর জন্য ভালো তবে তাদের অনেকেই অতটা মেমরেবোল নয়। অপরপক্ষে, একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর মিউজিক। আশির দশকের পাঙ্ক-রক পরবর্তী কালচারে বেড়ে উঠা ক্যাটের বেড্রুমের দেয়াল থেকে শুরু করে ক্লাবের মিউজিক বা সাধারণ সাউন্ডট্র্যাকে পোস্ট-পাঙ্কের গাঢ় প্রভাব, তাই সাউন্ডট্র্যাকের কমার্শিয়ালাইজেশনের যুগ হোক বা যেই কারণই - টক টক, ইকো অ্যান্ড দি বানিম্যান, টিয়ার্স ফর ফিয়ার্স, দি জিসাস অ্যান্ড মেরি চেইন, ককট্যু টুইন্স এর মতন প্রিয় ব্যান্ডের বিভিন্ন সৃষ্টি সম্বলিত অসামান্য সাউন্ডট্র্যাক।

কিন্তু সফল গল্পের চেয়ে ব্যর্থ গল্পের সংখ্যাই বেশি। আর এটিই হয়তো গল্পের মধ্যে মাইক্রোগল্পের আধিক্যের বড় সমস্যাঃ স্যাচুরেটেড গল্পের চাপে কল্যাটেরাল হিসেবে অন্যান্য ক্ষুদ্র গল্পগুলো 'লস্ট ইলিমেন্ট' হিসেবে অসম্পূর্ণ রয়েই যাবে (উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্টেরিওটিপিক্যাল বডি পজিটিভ ফ্রেন্ড বেথ, স্টেরিওটিপিক্যাল গেই ফ্রেন্ড মিকি, ইত্যাদি)। 


এত গল্পের ভিড়েও বেশ কিছু ইলিমেন্ট মনে লেগে থাকার মত ঠিকইঃ আমার জন্য বিশেষ করে ক্যাটের শৈশবকালের একটি স্মৃতি তার মায়ের সাথে বেডশিটের নিচে খেলা করার। দৃশ্যটি বেশ সেন্টিমেন্টাল - যে ফিল্মের কোন এক পর্যায়ে ক্যাট আর ইভের প্রতি মায়া জন্মে যেতে বাধ্য। তবে যারা কানে কুইয়ার পাম জিতে যাওয়া আরাকির সাথে পরিচিত তারা জানবেন যে তিনি নিজের গতিবেগ ছাড়া আর কোনকিছুর সাথেই চলতে অবাধ্য। এভাবে বলা যায়, White Bird in a Blizzard বেশ 'underwhelming' হলেও শিল্পী হিসেবে আরাকি সফল।  

Comments

Popular posts from this blog

The Eyes of My Mother: নারী, প্রকৃতি, বিচ্ছিন্নতা

রিভিউঃ Sala samobójców (2011)

চাইনিজ জেসমিন টি