মফস্বল স্বপ্ন ও একটি লাঞ্চবক্সের গল্প
[minor spoilers]
সাবার্বান, মফস্বল, মধ্যবিত্ত যেটাই বলা হোক না কেন - এই ধরণের জীবনের ব্যাপারগুলোকে সেলুলয়েডে বন্দি হতে দেখার অনুভূতিটাই অন্য। না হাই-পলিশড কাচের তৈরি সেটিং, না নাইট্রো ফুয়েল্ড ১৭০-এমপিএইছ, বা জটিল লজিকের সিনেমা (যদিও জটিল লজিকের সিনেমাগুলোই আমার লিস্টে প্রথমদিকে থাকে)। যেই কারণে হুমায়ুন আহমেদের বই পড়তে, বা ওং কার-ওয়াই এর সিনেমা দেখতে ভালো লাগে। পশ্চিমা 'সাবার্ব' থেকে এশিয়ান 'মফস্বল' এর পার্থক্য এভাবেও চোখে পড়ে। যাইহোক, ভালো নোট দিয়ে The Lunchbox (2013) এর রিভিউ শুরু করলাম।
হিন্দি সিনেমা কম দেখার দলে আমি, এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা - সবার মত 'থ্রি ইডিওটস'ও অলসতার ছলে অনেকদিন দেখা পিছিয়ে রেখেছিলাম। তারপর ইন্ডি ধাচের 'দি লাঞ্চবক্স'এর নাম দেখে আমিও উৎসুক হলাম। রিতেশ বাত্রার ডেব্যু ফিচার ফিল্মঃ বাফটা, কান-এ জয়জয়কার।
গল্পটা সিম্পলঃ ইলা নামের এক মধ্যবিত্ত গৃহিণী তার চাকরিজীবী স্বামীর জন্য খাওয়া রান্না করে পাঠায় লাঞ্চবক্স বা 'ডিব্বা' ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমেঃ গোলমাল বাঁধে যখন ঠিকানা অদলবদল হয়ে যায়; এভাবে তৈরি হয় এক অদ্ভূত পরিচয়।
কাহিনীটা যেমন ইন্টেরেস্টিং, এন্ডিংটা প্রায় 'কাল হো না হো' টাইপের - এন্টিক্লাইমেটিক। কিছুটা ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্টঃ কিন্তু আমরা এটা মেনে নেই - গল্পের বিল্ডিং টা ধীর, রিস্ট্রেইন্ড। খুব দ্রুত হঠাৎ করে কিছু এগিয়ে যায়না, আবার অনেক দ্রুতই বলা যায়। সময়টা একমাসের যদিও একমাসে গল্পটা শেষ হয়েছে বলে মনে হয়না।
কাহিনীটার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এর বলার ধরনটা। গল্পের আশেপাশের গল্পগুলো।
ভালো লেগেছে কিভাবে রিতেশ তার প্রধান গল্পের সাথে শহরের বিভিন্ন ইলিমেন্টগুলোকে সমান্তরালে যুক্ত করে দিয়েছেন। যেমনঃ ট্রেনে গান গাইতে গাইতে যেতে থাকা দলগুলো , বা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে থাকা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, গরমের মধ্যে ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে বসে থাকা, বা রাস্তায় বসে থাকা পেইন্টাররা।
আবার সূক্ষ্মভাবে গল্পটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপকরণগুলো। প্রধানতঃ লাঞ্চবক্স; যেমনঃ ইলা ও ফার্নান্দেসের পরিচয় হওয়ার আগে পরিচয়ের বাহন ছিল লাঞ্চবক্সটি - তাই সাবকনশাসলিই হয়তো এর রাস্তায় চলাচলের মূহুর্তগুলো মনের ফ্রেমে বন্দি হয়; কিন্তু পরিচয়পর্ব শেষে বক্সটি আর আসল নয়।
পুরো গল্পে প্রধান চরিত্র আসলে সম্পর্কগুলো - যা গল্প ও চরিত্রগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়। দেখা যায় কিভাবে দূরুত্বের চেয়ে কানেকশনটাই মূল। আবার পরিচয়ের সময়কাল ও গভীরতাও। ইন্সট্যান্ট মেসেজিং এর আগের ব্যাপারস্যাপারের ভরটাও কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। চিঠির পালা-পর্ব শেষ হওয়ার পরেও দেখি চিঠি চালাচালি। কিন্তু পার্থিবভাবে নয়, মনেমনে। এই ডিজিটাল যুগেও কি সেই ধরনের চিঠি লেখা শেষ হয়েছে?
এই কানেকশনগুলো সার্বজনীন...মফস্বল সেটিং-এ আমরা সেটা আরো অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করতে পারি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে ধোঁয়াওঠা গরম চায়ের কাপ হাতে নেয়ার মতন...আমার কাছে মনে হয় ব্যাপারটি কাকতালীয় নয় যে একপর্যায়ে ইলাকে চিঠি পড়ার সময় দেখি চা নিয়ে বসা শুরু করতে। তার কাছে এই দুইটি কাজের অনুভূতি একই।
এই কানেকশনগুলো সার্বজনীন...মফস্বল সেটিং-এ আমরা সেটা আরো অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করতে পারি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে ধোঁয়াওঠা গরম চায়ের কাপ হাতে নেয়ার মতন...আমার কাছে মনে হয় ব্যাপারটি কাকতালীয় নয় যে একপর্যায়ে ইলাকে চিঠি পড়ার সময় দেখি চা নিয়ে বসা শুরু করতে। তার কাছে এই দুইটি কাজের অনুভূতি একই।
প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি আমরা যেমন দেখি হাবাগোবা কিন্তু সহজ-সরল শেখের গল্প, বা উপরের বাসার আন্টির গল্প, তেমনি অফ-স্ক্রিন চরিত্রগুলোর গল্পঃ একজন নামহীন মা, যার গল্প হারিয়ে যায় শহরের অন্য গল্পগুলোর মাঝে; কিন্তু কোনভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনা - কারণ এই গল্পটা যে কারওরই হতে পারে, ইলারও।
এখানেই সিনেমাটিতে ওং কার-ওয়াই এর সিনেমার মিল পাই; তাঁর কাহিনীর প্রতিটি চরিত্রই যেন আলাদা আলাদা গল্প, শুধু প্লট ড্রাইভ করার অংশ না - এবং তাদের কমবেশি সবাইকেই নিয়ে চিন্তা করা যায়, যদি পছন্দ না-ও করা যায়।
আরো ভালো লেগেছে আমাদের সাধারণ জীবনে দেখা চরিত্রগুলোর রূপায়ণঃ গৃহিণী ইলার পরম যত্নে দোলমা রান্না করা, যেমনটা দেখতাম আমাদের মা-দের করতে, বা অসামাজিক ফার্নান্দেসকে যার চরিত্র বেশ সুন্দরভাবে বৃদ্ধি হতে থাকে গল্পের সাথে সাথে।
সাদামাটা সেটিং, স্টেডিক্যামঃ টিপিক্যাল হিন্দি সিনেমার মত প্যান-জুমের আধিক্য নেই। প্রায় পুরো ফিল্ম জুড়ে স্টিল মিডিয়াম সিঙ্গল বা টু-শট; দুই-তিনটি ফ্রেমড শটের অসামান্য ব্যবহার। অনুজ্জ্বল, ওয়ার্ম, প্রায় নস্টালজিক কালার স্কিমঃ বেইজ এবং হাল্কা নীল-সবুজের আধিক্য। যা এই চরিত্রগুলোর আরো কাছে এনে দেয়।
সিনেমার কাহিনীতে দুই-একটি লাইট-হার্টেড মূহুর্ত আছেঃ বললাম জানানোর যে, সুপার-টেন্স, সুপার নস্টালজিক একটা গল্প যে শুধু তা না। এছাড়া কিছু অতিপ্রাকৃত টাইপ ঘটনা আছে; একধরনের ভার্বাল-ভিসুয়াল ম্যাচ শটের মিলনের মাধ্যমে এক সুপারন্যাচারাল একটা ঘোর আনা হয়েছেঃ যেটি খুবই মাইনর, এবং কারণহীন ( সৌলমেট বা এক-পিরিচ-আত্মা ইত্যাদি নোশন অনেকটাই ভেঙে যাবে শেষেরদিকে )। কিন্তু এটি আমাদের এই এলাকার আধিভৌতিকের প্রতি একটা টানকে শ্রদ্ধা করে।
অ্যাক্টরদের ভূমিকা অসাধারণ (অবশ্য সত্যি বলতে হিন্দি সিরিয়াল ছাড়া এমনিতে ইন্ডিয়ান মিডিয়াতে অতিরঞ্জিত অ্যাক্টিং আমি কমই দেখেছি, দেন অ্যাগেইন)। ইরফান খান ছাড়া আমি আর কাউকে চিনতাম না - সেই দিক থেকে আমি অভিভূত। সাউন্ডট্র্যাকে দুইটা ক্লাসিক হিন্দি সিনেমার গান শুনতে পাওয়া যায়; যেটা আরেকটা বোনাস।
এই গানগুলোর ব্যবহারই সিনেমাটিকে আলাদা মাত্রা দেয় - হয়তো এই কারণেই রিতেশ আরো বেশি সাম্প্রতিক হিট গানগুলো ব্যবহার করেননি, বরং করেছেন ক্লাসিক হিটগুলোকে যেগুলো ছেলে-বুড়ো সবাই শুনেছে - যার ফলে সেই 'টাইমলেস' আবহটাকে আরো সুন্দরভাবে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে। এই মধ্যবিত্ত জীবনটার এই 'হাজার বছর ধরে' বৈশিষ্ট্যটার জন্যই আমরা 'হিমু' আর তার পৃথিবীর সাথে কানেক্ট করতে পারি, সময় যতই এগোক না কেন। 'দি লাঞ্চবক্স' সিনেমাটিতে এই জীবনের এই বৈশিষ্ট্যটি এত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে যে - স্ক্রিনে দেখে মায়া জন্মাতে বাধ্যঃ সেটা নিজের জীবন থেকে দেখেই হোক, বা শুধু সেলুলয়েডে আরেক জাতির জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি হিসেবেই হোক।
এই গানগুলোর ব্যবহারই সিনেমাটিকে আলাদা মাত্রা দেয় - হয়তো এই কারণেই রিতেশ আরো বেশি সাম্প্রতিক হিট গানগুলো ব্যবহার করেননি, বরং করেছেন ক্লাসিক হিটগুলোকে যেগুলো ছেলে-বুড়ো সবাই শুনেছে - যার ফলে সেই 'টাইমলেস' আবহটাকে আরো সুন্দরভাবে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে। এই মধ্যবিত্ত জীবনটার এই 'হাজার বছর ধরে' বৈশিষ্ট্যটার জন্যই আমরা 'হিমু' আর তার পৃথিবীর সাথে কানেক্ট করতে পারি, সময় যতই এগোক না কেন। 'দি লাঞ্চবক্স' সিনেমাটিতে এই জীবনের এই বৈশিষ্ট্যটি এত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে যে - স্ক্রিনে দেখে মায়া জন্মাতে বাধ্যঃ সেটা নিজের জীবন থেকে দেখেই হোক, বা শুধু সেলুলয়েডে আরেক জাতির জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি হিসেবেই হোক।
Comments
Post a Comment