কানাশিমি নো বেলাদোন্নাঃ এম্পাওয়ারমেন্ট ও কালচারাল ন্যারেটিভ

[ minor spoilers ]

ফিল্ম নিয়ে কথা বলা হবে আর ফেমিনিজম নিয়ে কথা হবেনা ? স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের সাথে ইনক্লুসিটিভিটি অর্থাৎ সব বর্ণ, এথনিসিটি এবং জেন্ডার স্পেক্ট্রামের সম্মিলন ও এর সমপর্যায়ের আলোচনা ইত্যাদি অনেক বিষয় লাইমলাইটে এসেছে; কিন্তু এর গোড়াটি ছিল আরো বেশি সরলরৈখিক, কিন্তু আরো বেশি কঠিন। বাংলার সমাজের, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম সমাজের জন্ম হিসেবে আমাদের প্রথমে জানা, 'ফার্স্ট লাইট' ছিলেন বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)।



  ওয়েস্টার্ন সমাজের ফেমিনিজমের ইতিহাস আরেকটু পুরোনো, আরেকটু পলিটিক্যাল। মিসোগাইনির বিরুদ্ধে লেখা শুরু হয় ১৪শ-১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, কিন্তু প্রকৃত রূপ পায় অষ্টাদশ শতকের শেষে, রেঁনেসা যুগের শেষ পর্যায়ে, যা 'দি এইজ অফ এনলাইটেনমেন্ট' নামে পরিচিত। এই সময়ে নারীদের ভোটাধিকারসহ পুরুষের সমপর্যায়ের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য ও নারী-পুরুষের জন্য অবস্থিত নৈতিকতার অসম স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে লেখালেখি করেন  লর্ড বেন্থাম, মেরি ওলস্টোনক্রাফট প্রমুখ।  যার স্রোত আমরা উপমহাদেশে পেয়েছি পরের শতকে - তবে আমাদের শুরুটা ছিল শুধুই শিক্ষার অধিকার দিয়ে। তবে এর মূলে নারীদের কষ্ট ও যাতনার গল্প একইঃ

একটি পুরুষতান্ত্রিক সামন্তবাদী সমাজ যা মূলতঃ গোড়া ধার্মিক শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত - এবং যেই নারী এর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে চায় তাকে সমাজ দ্বারা স্টিগমাটাইজ করা হয়।


ওয়েস্টার্ন সমাজে এর সবচেয়ে বড় দুইটি উদাহরণ ছিলোঃ সেইলেম উইচ ট্রায়ালস (মাসাচুসেটস ১৬৯২-১৬৯৩) এবং জোন অফ আর্কের ক্রুশবিদ্ধকরণ (১৪৩১)। 
প্রথম ক্ষেত্রে, বিরাট একটি ভূমিকা রেখেছিল একটি বিশেষ ধরণের রোগ যা এর আক্রান্তদের মধ্যে সৃষ্টি করতো মৃগীরোগের বৈশিষ্ট্য, আর হ্যালুসিনেশন। (১৯৭৬ এ প্রকাশিত হয় যে এর মূল কারণ ছিল এরগট ফাঞ্জাই যা গম, রাই তে পাওয়া যায়)। পাশাপাশি ছিল, উচ্চবিত্তের দ্বারা বৈষম্য ও তাদের প্রতি ক্ষোভ, স্মলপক্স, যুদ্ধ ইত্যাদি। ক্রমে সেইলেমের অন্যান্য মেয়েদের মধ্যে রোগগুলো ছড়িয়ে পড়লে তাদের একেএকে জড়ো করা হয় এবং এভাবে প্রায় ১৫০ নারী, শিশুকে কোন বিচার ছাড়াই পাঠিয়ে দেয়া হয় অগ্নিদগ্ধে। এর পিছনের আরেকটি কারণ ছিল ধর্মান্ধতায় আবদ্ধ একটি সমাজ, যাকে এই নিমর্ম কাজ থেকে বিমুখ করতে কাঠখড় পোঁড়াতে হয়েছে। 
দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি আরো বেশি পরিচিত এবং আরো বেশি করুণাদায়ক। সামান্য কৃষিপরিবার থেকে উঠে আসা জোন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সফল্ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে ধরা পড়ে যায় - কিন্তু তার অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরের জন্য তাকে 'বিধর্মী' ট্যাগ লাগাতে পারেনা ব্রিটিশ সাপোর্টে বিচারক হিসেবে দাঁড়ানো  রোমান ক্যাথলিক চার্চের ক্লেরিকরা। অবশেষে 'পুরুষদের মত পোশাক' পড়ার অপরাধে এবং 'উইচ'  হিসেবে চিহ্নিত করে 'বিধর্মী' জোনকে ক্রসে ঝুলিয়ে অগ্নিদগ্ধ করা হয়। 



ব্যাপারগুলো জানা কিন্তু আবার মনে করার কারণটা হলো এঈচি ইয়ামামোতো ডিরেক্টেড Kanashimi no Belladonna (১৯৭৬) বা Belladonna of Sadness এ দুইটি ঘটনার সিম্বলাইজেশন স্পষ্টভাবে ফুঁটে উঠে। আনিমেরামা সিরিজের ৩য় ফিল্মটি জুলস মিশেলে-এর La Sorcière (Satanism and Witchcraft) বইটির উপর আংশিকভাবে ভিত্তি করে তৈরি (উল্লেখযোগ্য যে La Sorcière ফিল্মটির ফ্রেঞ্চ টাইটেল )। যদিও বইটিতে বর্ণিত উইচ কাল্টটির বিবিধ ব্যাখ্যা এখন অনেকটাই কাল্পনিক বলে গণ্য করা হয়, তারপরো এই বইটি মধ্যযুগীয় সময়ে নারী, বিশেষতঃ নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি সিম্প্যাথেটিক লিটারেচারের মধ্যে অগ্রগামী। মিশেলে-এর মতে উইচক্রাফট তৎকালীন সময়ের সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একটি হাতিয়ার। তিনি ফ্রেঞ্চ রিভোলুশনের বিশেষ পক্ষপাতী, তাঁর একটি বইও আছে 'জোন অফ আর্ক' শীর্ষক। 


অতি সংক্ষেপে কাহিনীটি এরকমঃ ফিউডাল ফ্রান্সে জোন ও জ্যান ভালোবেসে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। জ্যান সতী-সাব্ধী জানার পরও গ্রামের অধিকর্তা লর্ডের অতি উচ্চ 'বিবাহ ট্যাক্স' দিতে না পারার কারণে জোনকে অপমান করে বের করে দেয়া হয় এবং লর্ড ও তার সভাসদরা গণধর্ষণ করে জ্যানকে।
বিদ্ধস্ত, অত্যাচারিত জ্যান ফিরে এসে পায় এক কাপুরুষ জোনকে। তার দুঃখ ও কষ্টে সাড়া দেয় শয়তান, যে বিনিময়ে চায় তার দেহ ও আত্মা। ধর্মপ্রাণ জ্যান প্রথমে সাড়া না দিলেও পর্যায়ক্রমে সাড়া দেয় এবং এক অসীম প্রভাবশালী নারীতে পরিণত হয়। গ্রামের মানুষদেরকে শান্তি ও আনন্দদানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সে গ্রামের সেই হর্তাকর্তাদের কাছে 'ডাইনি' উপাধি পায় - এবং এই সীল দিয়েই তাকে জনসম্মুখে অগ্নিদগ্ধ করা হয়।

 

গল্পের প্রধান পয়েন্টটি শুরু হয় যখন শয়তানের আগমন হয় - এখানে তার আকার পুরুষ জননাঙ্গের মতন, একটি ফ্যালিক (phallic) সিম্বল। উইকা এবং প্যাগান ধর্মগুলোতে ফ্যালিক সিম্বলের বহিঃপ্রকাশ জাদুর কাঠি (wand) এর মাধ্যমে, যা শক্তি, ক্ষমতা, প্রকৃতির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ চিহ্নিত করে। ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার হলো যে, শয়তান তাকে প্ররোচিত করে তার কাছে জ্যানের আত্মা বিলিয়ে দিতে, কিন্তু শুরুতেই সে বলে, 'আমি তোমারই একটি অংশ'। প্রতি ক্ষেত্রে একে শক্তিশালী করার মাধ্যমে জ্যানের নিজের প্রতি বিশ্বাস আরো সুগঠিত হতে থাকে । এমনকি খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতি ক্ষেত্রে কোন সুপারন্যাচারাল ব্যাপার ছাড়াই জ্যান তার অবস্থার উন্নতি করে (ইনসার্ট ইংলিশ ফর টুডে রেফারেন্স)।  

 

এছাড়া সিনেমাটির আরেকটি দিক হচ্ছে সেক্‌শুয়াল লিবারেশনের থিম। দেখা যায় জ্যান নিজের সেক্সুয়ালিটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার মাধ্যমে একে তার শক্তিতে পরিণত করেঃ সিনেমার এক পর্যায়ে তার সবুজ রং পরিধান তাই-ই নির্দেশ করে (ন্যারেটর এখানে বলে থাকেন যে সবুজ রং ক্ষমতার প্রতীক)। শহরের সবচেয়ে কৃপণ মানুষটি তার সৌন্দর্যের কাছে হার মানে।

 এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে ফিল্মটি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়, এবং তখন জাপানে সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম পুরোদমে সচল। ফার্স্ট ওয়েভের কিছু মুখ্য দিক ছিল, ক্যাপিটালিজমের কবল থেকে নারী-পুরুষ উভয়কে মুক্তিপ্রদান, নারীদের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক কাজে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখার আইনটির উৎখাত, এবং উল্লেখিত লিবারেশনের দাবি। সেকেন্ড ওয়েভে জন্মনিয়ন্ত্রক ব্যবহারের অধিকারের ব্যাপারটি একটি শক্তিশালী পর্যায় অবস্থান করে। 
এর আলোকে সিনেমায় তুলে ধরা হয় রোমান ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা কার্যকর অনেকগুলো বিধিনিষেধ (যা বর্তমান সমাজ ইতোমধ্যেই বর্জন করেছে ); এগুলো সিনেমাটিতে আমরা দেখি সাধারণ মানুষের মুখের কথায় - রাজসভার মানুষ যখন সাধারণ মানুষদের জিজ্ঞেস করে কেন তারা দলেদলে এক 'ডাইনির' কাছে যাচ্ছে তখন উত্তরে বলা হয় তার দেওয়া রস (বেলাডোনার নিঃসন্দেহে) খেয়ে এক গর্ভবতী নারীর প্রসবযন্ত্রণা সেরে যায়, এক বয়স্কা তার মৃত স্বজনকে হারানোর বেদনা সম্পূর্ণরূপে ভুলে থাকতে পারে এবং এক নারীর জন্য এটি জন্মনিয়ন্ত্রণ হিসেবে কাজ করে।

 

গল্পের একটি পাইভোটাল পয়েন্টে যখন জ্যান তার আটকাবস্থা থেকে পালিয়ে এসে শয়তানের সামনে দাঁড়ায় - তখন সে তার পরিপূর্ণ রূপে আসন্ন। এই পর্যায়ে অবশেষে জ্যান তার আত্মা বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়, কিন্তু বিনিময়ে সে লাভ করে অসীম সর্বসুখ - গল্পকাররা বলতে চেয়েছেন যে তাকে বাঁধাগ্রস্থ করছিল সেসকল ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করার মাধ্যমে সে তার প্রকৃত অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছে।
এছাড়াও পরবর্তী সীনগুলোতে যেখানে গ্রামবাসীরা চার্চের সকল বিধি নিষেধকে ত্যাগ করে সেই সাইকিডেলিক মূহুর্তগুলোতে গ্রামবাসীদেরকে বক্ররৈখিক ফ্রিফর্ম আকৃতিতে দেখা যায়, অন্যদিকে দেখা যায় কঠোর-রুক্ষ্ম থামগুলোর ভাঙন ধরেছে। এভাবে কঠোর নিয়মকানুনের বেড়াজাল ভেঙে মুক্তিলাভ করে তারাও।

স্পষ্টতঃই আমরা এখানে দেখি সিনেমাটির গল্পকাররা দুইটি দায়িত্ব পালন করেনঃ একটি মূল গল্পের সুরের সাথে মিল রেখে 'উইচ'দের প্রতি ইতিবাচক একটি ছবি আঁকা, এবং নারীর ক্ষমতায়ণের দৃষ্টান্ত তৈরি করা, যা তাদের লেন্স দিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত হয়।
সিনেমাটিতে সরাসরিই দেখা যায় উল্লেখিত সেইলেম ও জোন অফ আর্কের ঘটনাগুলোর ছায়াঃ জ্যান এর কাব্যিক মৃত্যু এবং এর পরবর্তীতে মিছিলে অবস্থিত প্রতিটি নারীর চেহারা হয়ে যায় জ্যান এর চেহারা। তার জীবন বিলিয়ে দিলে সে প্রতিটি নারীকে যেন তার আদর্শে আদর্শিত করলো।

 

এখন আসবো ফিল্মটির সবচেয়ে আলোচিত দিকঃ সারিয়েল ভাবে পোর্ট্রেইট করা জ্যানের পরিবর্তনের বিভিন্ন ক্ষ্ণগুলো, এবং সেই ইনফেমাস 'অর্জি' সীন। বললে ভুল হবেনা, সিনেমাটি এর চরিত্রদের (প্রায় সবার) প্রতি যতটাই সিম্প্যাথেটিক, এর দর্শকের প্রতি ততটাই না। এজন্য প্রথমে অনেক শান্তিপূর্ণ ক্লিমট-জাতীয় বিয়ের সীনটির পরে হঠাৎ করে দেখানো হয় ধর্ষণের দৃশ্য - সিনেমার বাকি অংশ বাকি এর ব্যতিক্রম নয়। এবং এসকল দৃশ্য গুলো সরাসরি না দেখিয়ে দেখানো হয় প্রতীকীভাবে, যা মনে আরো বেশি প্রভাব ফেলে। 

বলতেই হবে, সিনেমাটিতে অবশ্যই একটি স্টেটমেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে একে যথেষ্ট পরিমাণ শক ইমেজারি দিয়ে পূর্ণ করে। কিন্তু সবগুলো সীনই বেশ ডিস্টার্বিং, এবং এগুলোর সময়কালকে অনেকক্ষণ ধরে টানা হয়েছে, (সেই সাথে জ্যানের কণ্ঠে সেক্সুয়াল শব্দ) এসব মিলিয়ে সিনেমাটি আর্টিস্টিকের চেয়ে তুলনামূলক বেশি পর্নোগ্রাফিক । 
যথেষ্ট ফেমিনিস্ট একটি আর্টপিস হলেও সিনেমাটি  Male gaze বা পুরুষদৃষ্টির ঊর্ধে নয়। Male gaze এর প্রসঙ্গে ন্যুডিটি এখানে মুখ্য নয়, বরং বিভিন্ন অ্যাংগল থেকে একে দেখানো হয় বেশ সময় নিয়ে, যা কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করেনা।     


সিনেমাটির আরেকটি জিনিস আমার চোখে পড়েছে তা হলো জ্যানের কাপুরুষ স্বামী জোন, যে একপর্যায়ে জ্যানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে শেষের দিকে জ্যানের কাছে ফিরে গেলে জ্যান তাকে মেনে নেয় হাসিমুখে। এরপরে জ্যানকে বলে কয়ে লর্ডের কাছে নিয়ে লর্ডটির উদ্দেশ্য তাকে মেরে ফেলা হলেও সে প্রথমে তাকে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলে, একপর্যায়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা (শুধুমাত্র লর্ডেরই নিচে) দেওয়ার কথা বললেও সে বলে, "না, আমার চাই পুরো পৃথিবী"(যাতে অবশেষে ক্রোধে লর্ডটি তার জন্য মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে)। যদিও এই উক্তিটি একটি স্টেট্মেন্ট, অবশ্যই , কিন্তু পুরো এক্সচেঞ্জটি আমার কাছে কিছুটা কমিক্যাল, অনেকটা সাধারণ আনিমের মতন মনে হয়েছে, যার কারণে সিনেমার শেষটি আমাকে অত বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি।

আরেকটি জিনিস হলো, আমরা দেখি যে, জ্যানকে অগ্নিকাষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হওয়ার সময় জোন (দুঃখে?) দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে , কিন্তু তার স্ত্রীকে পোড়ানোর সময় হঠাৎ করে সে সাহসী হয়ে যায়, এবং কুটিল বিচারক (লর্ড এবং হেড প্রিস্ট) দের দিকে আগুন ছুড়ে মারে যার ফলে তাকে বর্শাবিদ্ধ করে মারা হয় - এতে জ্যান অগ্নিদগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তার নাম উচ্চারণ করতে থাকে (যদিও অর্ধেক ফিল্মটিতে তার সাথে সে শুধু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে)। 


এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে জাপানি ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের সাথে ওয়েস্টার্ন ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের একটি মৌলিক পার্থক্য - তা হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ব্যাপারটা জাপানে কম ফোকাস করা হয়, অর্থাৎ কো-ডিপেন্ডেন্সিকে এখনও মূল্য দেয়া হয়ঃ যেটির ভালো দিক হচ্ছে পারিবারিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকা; কিন্তু এর নেতিবাচক দিক থেকে ফিল্মটি বের হয়ে আসতে পারেনি - অর্থাৎ সমাজের বন্ধন, তা যতই বিষাক্ত হোক না কেন, তার মধ্যে স্থিতিশীল থাকার ব্যাপারটা থেকে গল্পকাররা সরে আসতে পারেননি। এখানেই সিনেমাটির ব্যর্থতা। 
হয়তো দুইটির সাথে খাপ খাওয়াতেই শেষে জোনকে একটির জায়গায় শতশত বর্শায় বিদ্ধ করে, এবং জ্যানের পাশাপাশি তার দেহ একাধিকবার দেখিয়ে তাকেও 'শহীদ'এ পরিণত করার কিছুমাত্র চেষ্টা করা হয়েছে, বা তাকে  তার অপরাধ থেকে কিছু পরিত্রাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যা হয়তো একটি পার্সোনাল লেভেলে কিছু মোরালিটি ধারণ করতে পারে, কিন্তু বাকি সিনেমাটির কঠিন বার্তার সাথে খাপ খায়না।


আরো বলা যায়, তৎকালীন জাপানি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছিল বেশ অনেকগুলো 'পিঙ্ক ফিল্ম' (ব্লু ফিল্মের জাপানি ইকুইভ্যালেন্ট) । সেই সুর মিলিয়ে সিনেমাটির তৈরি নিজেই একটি স্টেট্মেন্ট। জাপানি সমাজে 'মিসোগাইনি' বা নারীর প্রতি নিচুদৃষ্টি (যা এখনো বিদ্যমান)  - এই কথাটি মাথায় রেখে বলা যায়, সিনেমাটি অনেক দিক দিয়ে সফল না হলেও, তবে গুরুত্বপূর্ণ।

যাইহোক, জাপানি সামাজিক ব্যবস্থা, পুরুষশাসিত মিডিয়া ইত্যাদির বিচারে সিনেমাটির গল্পের ন্যারেটিভ সেই দিকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, যেই দিকে গল্পটি গিয়েছে। 
অতএব বলা যায়, যে কোন পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট তৈরিতে কালচারাল ন্যারেটিভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত ১৯০০ সালের দিকে যেই ফেমিনিজমের জন্য আন্দোলন করেছিলেন তার ধারা এখনো বজায় আছে, কিন্তু সামাজিক বিচারে ওয়েস্টার্ন, এমনকি জাপানী ফেমিনিজমও আমাদের সমাজে গৃহীত হবেনা; তাই 'গেরিলা' (২০১১) এর মত ফিল্ম আমাদের সমাজের ন্যারেটিভে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঃ যেখানে নারী চরিত্রগুলোর ক্ষমতায়ণ করা হয়, কিন্তু ওয়েস্টার্ন ন্যারেটিভ (মূলতঃ সেক্সুয়াল লিবারেশনের ধ্যান ধারণা) পেশ করে সমাজে ফেমিনিজমের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়না।


এখন ফিল্মের অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সিনেমাটিতে অন্যান্য অনেক জাপানী লিটারেচারের মতন রূপকথার আভাস দৃষ্টিগোচর হয়ঃ প্রধানত, রাম্পেলস্লিটস্কিন (যে মেয়েটির খড়কে স্বর্ণসুতায় পরিণত করে দেয়ার বিনিময়ে তার প্রথম সন্তান চেয়ে থাকে)। যখন শয়তান জ্যানের কাছে সাফল্যের বিনিময়ে তার আত্মা চেয়ে থাকে তখনও সিনেমাটিতে একটি চরকা দেখা যায়। 
সিনেমার জোন চরিত্রটি সম্ভবত জঁ লমেইত্‌খ্র এর উপর ভিত্তি করে গঠিতঃ জোন অফ আর্কের বিচারের সময় জঁ নর্থার্ন ফ্রান্সের ভাইস-ইনকুইসিটর ছিলেন - তিনি জোনের ট্রায়ালের বিরোধিতা করলেও জনমত আছে জীবনের হুমকি দেয়া হলে তিনি ইংলিশদের সাথে যোগ দেন। 



'বেলাডোনা অফ স্যাডনেস' নামটি দিয়ে ফিল্মটির অনেক কিছু আঁচ করা যায়। ক্রিটিকদের মধ্যে একটি মত কমন, তা হলো - সিনেমাটি একটি সাইকিডেলিক ট্রিপঃ অনেকটা এলএসডি বা এরকম হ্যালুসিনোজেনিক দ্রব্যের এফেক্টের মতন, যার জন্য বেলাডোনা ফুলটি বিখ্যাত, অথচ অন্যদিকে ইতালিয়ান থেকে ট্রান্সলেশনে 'বেলাদোন্না' মানে সুন্দরী রমণী। দুইটি বিষয়ই একসাথে সিনেমাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। 
বেলাডোনার আরেক নাম ডেভিল'স বেরি; ফুলটি Solanaceae গোত্রের, যেটিতে আরো রয়েছে বিষাক্ত ধুতুরা, ও বিভিন্ন ধরনের নাইটশেড; ম্যান্ড্রেক, হেনবেইন। বেলাডোনা নিয়ে প্রচলিত মতামত যে এটি হ্যালুসিনোজেনিক স্বপ্ন উদ্রেক করার পাশাপাশি ব্যবহৃত হতো ব্যথানাশকে এবং অ্যাগ্রেসিভ ফিমেইল সেক্সুয়ালিটির প্রতীক। প্রতিটি সিম্বলিজমই দেখা যায় জ্যান থেকে বেলাডোনায় পরিণত হওয়া মেয়েটির মধ্যে। 


ফিল্মটির স্টাইলিস্টিক চয়েজ আনিমের মধ্যে অনন্য - কুনি ফুকাই-এর হাতে তৈরি ওয়াটারকালার ধাঁচের পেইন্টিং-এ যেমন ক্লিমটের রোমান্টিক ধাঁচের প্রকাশ পাওয়া যায়, তেমনি দেখা যায় কাডিন্সকির এক্সপ্রেশনিস্টিক রঙের পাশাপাশি গোএয়ার বিভিন্ন শেডের কালো।  ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ইলুস্ট্রেশনের মতো দৈহিক গঠন,সাথে আনিমের স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বড় চোখ (উল্লেখ্য যে চোখের মণির আকার বৃদ্ধি করতে ভিক্টোরিয়ান নারীরা চোখে ব্যবহার করতো বেলাডোনার রস) । যৌনতা থিমের অন্যতম অনুপ্রেরণা দেখা যায় মার্টিন ভ্যান মায়েলে-এর আর্ট থেকে, যিনি বিংশ শতকের অনেক ফ্রেঞ্চ ইরোটিকা সৃষ্টিতে প্রখ্যাত। এছাড়াও ডিটেইল্ড টু-ডাইমেনশনাল সারিয়েলিস্টিক কনসেপ্টটির মধ্যে দেখা যায় হ্যারি ক্লার্কের ছায়া - যিনি গ্যাটের 'ফস্ট' বইটিরও ইলুস্ট্রেশন করেছিলেন। এসকল আর্টিস্ট আর্ট নুভ্যু মুভমেন্ট এর সাথে জড়িত ছিলেন; এভাবে মডার্ন আর্ট আর লুসিফারিয়ান থিমের অসামান্য সম্মিলন দেখা যায় ফিল্মটির প্রচারে। 

Comments

Popular posts from this blog

The Eyes of My Mother: নারী, প্রকৃতি, বিচ্ছিন্নতা

রিভিউঃ Sala samobójców (2011)

চাইনিজ জেসমিন টি