অ্যাবসার্ডিসমঃ সুইসাইড ও ভালোবাসা

[ minor spoilers ]

ফিলসফিতে অ্যাবসার্ডিস্ম বলে একটা শাখা আছে - বলা যায় এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ম লাইনের দর্শনে। নিহিলিজম থেকে প্রশ্ন আসে যে পৃথিবীর কোন মিনিং নেই এবং তাহলে স্পিশিস হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের কোন অর্থ নেই? এর উত্তর হিসেবে সার্ত্রে একটা মত দেন যা এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ম নামে পরিচিত - তার মতে পৃথিবীর সৃষ্টিগতভাবে কোন অর্থ নেই সেটি ছাড়া, যা আমরা দিয়ে থাকিঃ একটি চেয়ার হচ্ছে চেয়ার, বসার জন্য কারণ আমরা তার রোল ঠিক করেছি সেভাবেই...যাইহোক তিনি বলে থাকেন - মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনের অর্থ তখনই তৈরি হয় যখন আমরা সেটা নিজেরা যাচাই করে নেই। 
এই যে বের করে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি, এটি কিন্তু শেষ বিচারের হিসেবে শূন্যঃ একটি চেয়ার, চেয়ার হলেও পৃথিবী ঘুরবে, না হলেও। কিন্তু কাঠের টুকরাটিকে চেয়ারের রোল দেয়া হয় বলে এটি কাঠের টুকরোর চেয়ে বেশি কিছু। আমরা কাঠের টুকরো নই যেহেতু তাই আমাদের রোল আমাদের নিজেদেরই বের করতে হবে। যদিও সেটিও শেষ বিচারে শূন্যইঃ তাহলে এই ''মিনিং'' খোঁজ করার ব্যাপারটা 'অ্যাবসার্ড', বা...অদ্ভূত না? কিন্তু তারপরও আমরা খুঁজে যাই - আর এটিই অ্যাবসার্ডিস্ম।       

সুইসাইড বিষয়ক সব সিনেমাতেই এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস না করা হলেও অজিজ্ঞাসিত প্রশ্নের মত বাতাসে ভেসে থাকে। আমরা বেঁচে আছি কেন? বেঁচে থাকার জন্য কোন ধরনের প্রশ্ন করবো? নিহিলিজমের ধারণাটা মূলতঃ আরো পরিপক্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, বিশেষ করে যুদ্ধবিদ্ধস্ত সমাজে; যদি সৃষ্টিকর্তা থাকেনই - তবে কেন এত ধ্বংসযজ্ঞ?  
সেই হিসেবে এটি স্বাভাবিক যে লেখক এটগার কেরেটের লেখায় সেই আইরনির আভাস থাকতেই পারে - তার বাবা-মা ছিলেন 'হোলোকস্ট' থেকে বেঁচে ফিরে আসা পোলিশ নাগরিক যারা ইসরায়েল আসেন। ইস্রায়েলি লেখক হিসেবেই তিনি পরিচিত তার বই 'নেলার্স হ্যাপি ক্যাম্পার্স' এঃ প্রসঙ্গক্রমে বল্লাম, কারণ এই বইটির উপর ভিত্তি করেই তৈরি, Wristcutters: A Love Story (২০০৬)। 


 মেন্টাল ইলনেস হিসেবে এই ফিল্ম ক্যাটেগরাইজ করা হয়, তবে আমার মতে এখানে সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলোর চাইতে ফিলসফিক্যাল ব্যাপারগুলোই মুখ্য। সিনেমাটি গোরান ডুকিচ-এর প্রথম ফিচার ফিল্ম এবং তিনি মূলতঃ এর স্ক্রিনপ্লেই লেখক। তাই ব্ল্যাক কমেডি ফিল্মটির অনেকাংশ ক্রেডিট তাকেই দিতে হয়; যাইহোক, নামটা থেকেই বোঝা যায় ফিল্মটিতে হাত কাটাকাটি জাতীয় ব্যাপার আছে। 
মূলতঃ গল্পটা এরকম, জিয়া নামের এক তরূণ মোটামুটি ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে আত্নহত্যা করে, এবং পার করে একটি মোটামুটি বিদ্ধস্ত একটি শহরে, যেখানে কেউ হাসেনা, আকাশে তারা নেই - দি হোওল প্যাকেজ; এগুলো ছাড়া জীবন আগের জীবনের মতনই, কিন্তু সত্যি বলতে, একঘেয়ে - এক অর্থে বলা যায়, এখানে দুঃখ পাওয়ার কোন কারণ নেই কারণ যারা এখানে আছে তারা তার মতই আত্নহত্যাকারীঃ তাদের ফিরে যাওয়া নিয়ে কোন দুঃখ নেই, কিন্তু আনন্দ পাওয়ার মত কোন কারণও নেই। 
এক সময়ে তার সাথে পরিচয় ইউজিনের সাথে (যে সপরিবারে এখানে বাস করে) - এক সময়ে সে খবর পায় যে, তার প্রেমিকা (যার জন্য সে এখানে এসেছে), সে-ও এই জগতে আছে। জানতে পেরে জিয়া মরিয়া হয়ে পড়ে তার প্রাণপ্রিয় ভালোবাসাকে ফিরে পেতে, সাথে যোগ দেয় তার নতুন বন্ধু ইউজিন।




মূলতঃ এটি একটি "রোডট্রিপ" সিনেমা (থেলমা অ্যান্ড লুইস, অন দ্য রোড ইত্যাদি দ্রষ্টব্য), তবে গল্পটি আসলে শুরু হয় যখন তাদের সাথে দেখা হয় মিকাল নামে একটি মেয়ের, যে দাবি করে সে এখানে ভুল করে এসে পড়েছে, এবং নিজের জীবনে ফিরে যেতে চায়।

ফিল্মটির ব্ল্যাক কমেডি ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছেঃ প্রথম দৃশ্যেই তাকে দেখা যায় অতি সাধারণভাবে তার হাত কেটে ফেলতে। মরে যেতে থাকা অবস্থায় সে দেখতে পায় তার বাথরুমের মাটিতে পড়ে থাকা একগোছা চুল।  একটা মানুষ মরে যাচ্ছে কিন্তু ব্যাপারটা কত স্বাভাবিকঃ তার শেষ নিঃশ্বাসে চুলগোছা জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। 
বাকি সিনেমাটিতেও সোজাভাবেই সুইসাইড ইত্যাদির কথা বলা হয়।  পরপার ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিবর্ণ ধরনের রং, অনেকটা পোলান্সকির The Pianist (২০০২) এর রং এর পার্থক্যের ব্যাপারটার মতঃ সিনেমাটির শুরুতে দেখা কালার গ্রেডিং এর সাথে সিনেমাটির বাকি বেশিরভাগ অংশের পার্থক্য অনেক বেশি। বেশিরভাগ 'এপার' দৃশ্যগুলো দেখানোর উদ্দেশ্য বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যুর উপায়গুলো দেখানো। তাই আইরনিকভাবে দেখা যায়, চরিত্রগুলোর মৃত্যুদৃশ্যগুলো ফুল কন্ট্রাস্ট কালার প্যালেটে, কিন্তু তাদের বেঁচে থাকা ও দৈনন্দিন কাজ করার দৃশ্যগুলো বেশ ধূসর, যা আমার কাছে বেশ ইন্টেরেস্টিং মনে হয়েছে।




গল্পের প্রধান একটি দিক হলো এর সাধারন কমেডি, যা চরিত্রগুলোর কথা কাজ আচরণ ইত্যাদিতে প্রকাশ পায়; ব্যাপারগুলো খুব লাইট-হার্টেড। সঙ্গত কারণেই মার্কেটিং হিসেবে কমেডি জনরা দেখে হয়তো অনেকেই মনে করেছিল দম ফাটানো হাসির ব্যাপার না হোক - পেটে খিল ধরা যেতে পারে; তারা সবাই ডিস্যাপয়েন্টেড হয়েছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, অনেক বেশি হাসির হওয়ার চেয়ে এভাবেই বরং ডার্ক হিউমারের ব্যাপারগুলো ফুঁটে উঠে, এবং কাহিনীকে সার্বিকভাবে একটা সফট একটা ভাইব দেয়, যা গল্পের শেষাংশে বেশি ভালো লাগে। 

গল্পে কমেডিকভাবে কিছু নিশে বা মাইক্রো আইডিয়া দেখা যায় সোশাল নিহিলিজম ব্যাপারে (নিহিলিজমের সামাজিক প্রয়োগ অর্থ এক মানুষের উপর আরেক মানুষ, পরিবার, সমাজ ইত্যাদির বন্ধনও অর্থহীন এই বিশ্বাসটি প্রতিস্থাপন করা - এভাবে এটি একদিক দিয়ে সব মানুষকে একটি সমতার স্থান দেয়)। উদাহরণঃ যখন ইউজিন এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দেখে ভয় পায় তখন জিয়া তাকে বলে - আমরা সবাই মারা গিয়েছি, সবাই এখানে মৃত। আমরা সবাইই তো ইমিগ্র্যান্ট।   



তবে, অল-ইন-অল, সিনেমাটি সহজ-সরল, লিনিয়ার (সরলরৈখিক)। মনে রাখতে হবে, এটি অবশ্যই নিহিলিস্টিক সিনেমা নয়, এটি একটি রোমান্টিক সিনেমা, তরুণদের জন্য তৈরি সিনেমাঃ এখানে জীবনের অর্থ হিসেবে ফোকাস করা হয়েছে ভালোবাসার উপর (আর সত্যি বলতে, তরুণ বয়সে এর চেয়ে প্রয়োজনীয় মনে হওয়ার মতন তেমন কিছু আছে?)। এক অর্থে এটি ডার্ক কমেডির মোড়কে ঢাকা জন গ্রিন ভাইবের একটি ফিল্ম। এতে অবশ্য কোন গম্ভীর বাণী চিরন্তনের ভার নেই - শুধু উষ্ণ সহজ কিছু উক্তি যা বেশ ভালো লাগে। ফিল্মটি নিজেকে অনেক বেশি সিরিয়াসলি নেয়না, এই ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। 
এক কথায় কিশোরকালে যখন চাইতাম যে প্রধান নারী-পুরুষ চরিত্রগুলা তাড়াতাড়ি হাত ধরুক, তখনও যেমন ভালো লাগতো, এখন বড়কালে যখন আমরা বুঝতে শিখেছি জীবন এক অর্থে অর্থহীন, কিন্তু তার মাঝে বেঁচে থাকার কারণ হিসেবে আমরা ফেইক সেন্স অফ অ্যাকমপ্লিশ্মেন্ট বা ক্ষণস্থায়ী অনিশ্চিত ভালোবাসাকে গ্রহণ করি, তখনও বেশ ভালো লেগেছে রিস্টকাটার্স



গল্পের ভালোলাগার র‍্যান্ডম কিছু দিক বলতে চাইঃ এর ৩ডি গ্রাফিক্স; কিছুটা হাস্যকর - কিন্তু আমাদের টিনেজকালের সিটকমের কথা মনে করিয়ে দেয়, গল্পের ওভারল ভাইবের সাথে খাপ খায়। আরেকটা জিনিস অনেক ভালো লেগেছে তা হলো কাস্টিং। এ সিনেমাটিতেও কাহিনীর সাথে চরিত্রগুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণঃ আর প্রতিটা অভিনেতাই তা ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন; প্রধান চরিত্রে জিয়া হিসেবে প্যাট্রিক ফিউগিটকে কেউ ভালোবাসেন, কেউ একদমই না। আমার মতে ডিপ্রেসড একটি চরিত্রে তার একস্বরা কণ্ঠ ভালোই মানিয়েছে;মেমেরোবল চরিত্র ছিল বিদ্রোহী চরিত্রের মিকাল হিসেবে শ্যানান সোসামন ও নেলার হিসেবে টম ওয়েইটস (গায়ক টম ওয়েইটস যে এটা কোন এক কারণে আমার মাথায় সাথে সাথে আসেনি!)। আর কিং হিসেবে উইল আর্নেট (অ্যারেস্টেড ডেভেলপমেন্ট ফ্যানরা তাকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে)। 


 


আরেকটা মনে রাখার মতন দিক ছিলো ফিল্মটির সাউন্ডট্র্যাক। সবার জন্য কিছু ফান ফ্যাক্টঃ
ইউজিন চরিত্রটি আসলে গোগোল বর্দেলো ব্যান্ডটির ইউজিন হাজের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (যিনি নিজেও রাসিয়ান)। ফিল্মে ইউজিনের ব্যান্ডের গান হিসেবে যেই ক্যাসেটগুলো ছাড়া হয় সেগুলো গোগোল বর্দেলো দ্বারা সৃষ্টি।
এছাড়া ট্ম ওয়েইটস, মিকাল লাজারেভ (নানুক চরিত্রের কাস্ট) এবং মাশম্যান ব্যান্ডের (প্যাট্রিক এই ব্যান্ডের একজন মেম্বার) দুইটি গান আছে।
এছাড়া 24 to Sector Z ছাড়া বাকি যেসব ব্যান্ড ও আর্টিস্ট ( জয় ডিভিশন, ডেল শ্যানন, ডেভিড সাচ, গ্রাম পার্সন্স, জো মিক, ক্রিশ্চিয়ান ডেথ ) এর গান ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মিল হচ্ছে সেই আর্টিস্ট ও ব্যান্ডের পার্ফর্মিং মেম্বার (ডিভিশনের ইয়ান কার্টিস ও ডেথের রজ উইলিয়ামস ) সবাই সুইসাইড করেছিলেন। (RIP)
এছাড়া Gloomy Sunday একটি ক্ল্যারিনেট অ্যারেঞ্জমেন্টও আছে সাউন্ডট্র্যাকটিতে। 



Comments

Popular posts from this blog

The Eyes of My Mother: নারী, প্রকৃতি, বিচ্ছিন্নতা

রিভিউঃ Sala samobójców (2011)

চাইনিজ জেসমিন টি