বিকালবেলার পাখিঃ জীবনের ফ্রেম,মধ্যবিত্ত রং
বাংলাদেশে টেলিফিল্ম ক্যাটেগরিটা অনেকটাই নতুন - তাই আমার দেখা বেশিরভাগ টেলিফিল্মগুলো গল্পপ্রধান এবং ফরম্যাটগুলো নাটকের কাছাকাছি। শুধুমাত্র ছোটপর্দার জন্য টার্গেটঃ তাই টেলিফিল্ম স্পেসিফিক্যালি সিনেমা এক্সপিরিয়েন্স হবেনা এটাই স্বাভাবিক। তার মধ্যে কিছু কিছু টেলিফিল্ম এর বিষয় আর আর্ট ডিরেকশন সিনেমার অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে যায়। রাইটার-ডিরেক্টর আদনান আর রাজীবের নির্দেশনা আর কামরুল হাসান খসরুর ফটোগ্রাফিতে বিকাল বেলার পাখি (২০১৭) টেলিফিল্মটি, এরকমই, নাটকের চেয়ে সিনেমার একটু কাছাকাছি।
ইদানিং টেলিফিল্ম বিষয়টা অনেক জনপ্রিয়। বিশেষ করে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর নাটক, সিনেমা ও টেলিফিল্মের সাবলীলতার ইনফ্লুয়েন্স বর্তমান টেলিফিল্মগুলোর উপর বেশ চোখে পড়ে। বিকাল বেলার পাখি তার ব্যতিক্রম না হলেও এর নিজস্ব একটা স্বকীয়তা আছে, যা অনেকটাই সিনেমাটিক। বিশেষত এর কালার স্কিম ও ফ্রেমিং-এ। যা দিয়ে রাজীব বেশ সফল্ভাবে তুলে ধরেছেন টেলিফিল্মটির প্রধান বিষয়ঃ মধ্যবিত্ত জীবন।
সিনেমাটির ওপেনিং সীনেই দেখা যায় একটি মাছের বাজারের দৃশ্য; এবং চোখে পড়ে বাবা ও ছেলের একসাথে বাজার করার দৃশ্য। মাছের বিক্রেতারা সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত; পক্ষান্তরে, ক্রেতারা মধ্যবিত্ত তাই তাদের একধরনের আশা থাকে - যা আমরা প্রথমেই দেখি ছেলের একধরনের জোরহীন দাবিতেঃ তার পাঙ্গাশ মাছ খেতে ভালো লাগেনা।
লাইটগুলো বিক্রেতাদের উপর ফোকাস করা - বাজারের প্রধান চরিত্র এই বিক্রেতারাই, কিন্তু শটের কেন্দ্রে বাবা ও ছেলে থাকলেও মিউটেড রঙে তারা অনেকটাই মিশে যায় সীনের অন্যান্যদের সাথে। খুবই সাধারণ দৃশ্য কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাব বহন করেঃ মধ্যবিত্তরা আমাদের চোখে অনেকটাই 'ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যারেক্টার'।
মূলতঃ পুরো টেলিফিল্মের সবচেয়ে ইন্টেরেস্টিং ও চোখে পড়ার মত বিষয় হলো এর কালার স্কীমের প্রতি ভক্তি। যেমনঃ এই 'মিউটেড কালার স্কীম' যা পুরো টেলিফিল্মটি জুড়েই স্থায়ী। এমনকি টেলিফিল্মের দুইটি সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী দুইটি সিকোয়েন্সঃ প্রথমটি হলো পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে -
এটি তার জন্য আপাত সবচেয়ে খুশির ঘটনা, এবং তার ধ্যানজ্ঞান; যদিও তার খুশির ঘটনা একইসাথে তার কষ্টের ঘটনাও। এবং আমরা ধারণা করি এটি হয়তো স্বপ্ন, হয়তো স্বপ্ন না... যদিও এই সিকোয়েন্সটির শেষাংশ আমাদের ভুল ভেঙে দেয়। টেলিফিল্মের অন্যান্য সিকোয়েন্সের সাথে রঙের এই ধারাবাহিকতা এই দুইটা ভাবই একইসাথে অনেক সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর আমাকে একই সাথে বুঝিয়ে দেয় যে মধ্যবিত্তদের বাস্তবজীবনের সাফল্যটাই তাদের স্বপ্ন, এর বেশি কিছু নয়।
এছাড়াও পুরো ফিল্মে বিভিন্ন সিকোয়েন্সে আমরা দেখি একরঙের প্রাধান্য; এর তুলনামূলক রঙিন দৃশ্যগুলোতেও রঙের বাহার নেই - মূলতঃ কমপ্লিমেন্টারি (বাসের নীল-হলুদ) বা ট্রিয়াডিক (যেমন নিচের দৃশ্যটিঃ লাল-নীল-সবুজ) ব্যবহার দেখা যায়।
এখানে আমার সবচেয়ে পছন্দের ব্যাপার হল রঙের মাধ্যমে অনেক বেশি ভাব প্রকাশ করার ব্যাপারটা। যেমনঃ ছেলেটিকে (যে বেশিরভাগ সময় নীল রং পড়ে) মায়ের সাথে এই কথোপকথনের দৃশ্যে দেখা যায় তার ফ্রাস্ট্রেশন প্রকাশ করতে। এখানে তাকে লাল পড়তে দেখা যায়।
আবার যেসকল জায়গায় তার বাবা যায় সাহায্যের আশায়, সেখানে হালকা হলুদ রংটাই ডমিন্যান্ট। এই রংটা অনেক উষ্ণ - এবং আমরা দেখিও যে সেখানে তারা এই হতশ্রী বাবার প্রতি অনেকটাই সহানুভূতিশীল।
পক্ষান্তরে, শেষের দৃশ্যটি (আমার কাছে দ্বিতীয় সবচেয়ে সিম্প্যাথেটিক দৃশ্য) অনেক হৃদয়গ্রাহী, আর ছোট মেয়েটির মত আমাদের কাছেও কিছুটা আকস্মিক - কিন্তু এখানে রঙের কোন আধিক্য নেই, বা নেই কোন জাম্পকাট। টেলিফিল্মের বেশিরভাগ সিকোয়েন্সের অনুরূপ ঘোলাটে নীল রঙের প্রাধান্য; অনেকটা সাধাসিধেভাবেই এটি পার হয়ে যায়। আমাদেরকে যেন বলে যে এটি সাধারণ জীবনপ্রবাহের বাইরে কিছুই নয়।
এছাড়াও টেলিফিল্মটির আরেকটি চোখে পড়ার মত দিক হলো এর ফ্রেমিং। সব সিকোয়েন্সই ফ্রেমিং এর নিয়ম কঠোরভাবে পালন করেনা, কিন্তু কোন কোন দৃশ্যে এটি দিয়ে গল্পের বাইরের গল্প বলার ব্যাপারটা দারুণ। নিচের দৃশ্যটি সহ পরিবারের অন্যান্য দৃশ্যে আমরা দেখি চরিত্রগুলো বেশ কাছাকাছিই অবস্থান করছেঃ তাদের মধ্যে এই গভীর বন্ধনটি চোখে না পড়লেও অনুভব করা যায়।
আবার আমার পছন্দের একটি সিকোয়েন্সটিতে দেখা যায় ডিরেক্টর বেশ কৌশলের সাথে দুইজনকে আলাদা করে রেখেছেন, যেটি আবার দেখা গিয়েছিল বাবার সাথে কথোপকথনের দৃশ্যে (ছেলের ক্ষেত্রে দূরুত্ব আরো বেশি দৃষ্টিমান)। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে সে তাদের মধ্যে সহানুভূতিশীল হলেও তাদের মধ্যে একধরনের দূরুত্ব বিদ্যমান। যাদের কাছে আমরা সাহায্যের জন্য অনেক সময় হাত পাততে বাধ্য হই তাদের কাছে আমরা সহানুভূতিরই পাত্র, বন্ধুত্বের নয়...।
আবার দেখা যায়, ছেলেটির বন্ধুদের বাসায় তার বন্ধুর বাবার এসে কথোপকথনের মাধ্যমে। ডায়ালগগুলো তিনি হয়তো দাঁড়িয়ে দিতে পারতেন কিন্তু তাকে আমরা দেখি ছেলেগুলোর কাছাকাছি বসতে, আবার ছেলেটির পয়েন্ট-অফ-ভিউ থেকে কিছুটা উঁচুতে। আমরা সহজেই বুঝে ফেলি সেই বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতা, আবার তার প্রতি ছেলেটির কিছু সম্মান - দুইটিই আসে তার পরিবার অপেক্ষাকৃত ধনবান হওয়া থেকেই, বোধ হয়।
আরেকটি সুন্দর ফ্রেমিং এর ব্যাপারটি দেখা যায় নিচে, যেখানে ছোট মেয়েটি তার ভালোবাসার জিনিস হারিয়ে বুঝতে শিখেছে মধ্যবিত্ত জীবনের স্যাক্রিফাইসের অংশ...এখানে তাকে আপন মনে দোল খেতে দেখা যায়। এই কম্পোজিশনটি ও এর পরবর্তী ক্লোজশট থেকে আমরা আঁচ করতে পারি তার নিজের মনে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা, কিন্তু সেখানে আমরা তার সাথে অংশ নিতে পারিনা, শুধুই দেখতে পারি। কিন্তু পরক্ষ্ণে ছেলেটির সাথে তার বাবার মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যে যদিও তার পয়েন্ট-অফ-ভিউ জুড়ে বাবাকে ক্লোজআপে দেখা যায় - এতে আমরা বুঝতে পারি যে বাবা তার উপর প্রভাবশালী, কিন্তু এই মূহুর্তে বাবার প্রতি তার সম্মান বা ভয় নেইঃ অর্থাৎ তাকে নিজের সমপর্যায়ে মনে করেই বাবার প্রতি অভিযোগগুলো করে ছেলেটি।
যা আমাকে মনে করিয়ে দিল টেলিফিল্মটির আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথাঃ সীমিত পরিমাণ ক্লোজআপ শটগুলো ইন্টেন্স ইমোশনের পরিচয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে দেখি , আর দেখি দুইটি ক্ষেত্রে ক্যারেক্টার শট যেগুলো অনেকটা হ্যান্ডহেল্ড ধরনেরঃ এই দুই ক্ষেত্রেই চরিত্রগুলোকে দেখা যায় অনেকটা চিন্তার ঘোরে বন্দি অবস্থায়...
কিন্তু ডমিন্যান্ট হলো ওয়াইড অ্যাংগল শট ও বেশিরভাগ মিডিয়াম ও লংশট। আমরা একটা পরিবারের জীবনযাত্রা দেখছি দূর থেকে।
এই সবগুলো থিম একসাথে জড়ো হয় এই শেষ সিকোয়েন্সটিতে, এবং বাই ফার, পুরো টেলিফিল্মের সবচেয়ে পছন্দের সিকোয়েন্স। এখানে আমরা দেখি ছেলে ও বাবার কাছে আসাঃ ছেলে ও বাবা দুইজনই সাদা রং পরিহিত, এবং অন্যান্য দৃশ্যগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি কাছে। তাদের আলিঙ্গনের সাথে ক্রসকাটে দেখা যায়, এক বাবার কোলে তার ছোট সন্তানঃ শেষ দৃশ্যের নন-ডায়াজেটিক ভয়েসওভারে আমরা যেমন শুনতে পাই এক বাবার প্রতি তার ছেলের ভালোবাসা, তেমনি দেখতেও পাই কিভাবে এক বাবার কাছে তার সন্তানরা সবসময় ছোট শিশুটিই হয়ে থাকে। এই মমতাপূর্ণ ভাবটি টেলিফিল্মের অন্য সব রেশারেশি, কষ্ট, সব দুঃখকে ছাপিয়ে যায়। আমাদের মনে করিয়ে দেয়ঃ এক মধ্যবিত্ত পরিবারের বন্ধন যেন চাওয়া-পাওয়ার সব পরীক্ষাকে পার করে যায়।
টেলিফিল্মটির একেকটি চরিত্রের প্রতি আলাদা করে ফোকাস করা হয়েছে তাদের সম্পর্কের মাধ্যমে। এম্নিতে এর স্কোপটি খুবই ছোট - কিন্তু প্রায় প্রতিটি চরিত্র, মূলতঃ পরিবারের চারজন চরিত্রের ক্যারেক্টারাইজেশন সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের হুবুহু প্রতিচ্ছবি। গল্পটি ও এর কনফ্লিক্টটি খুবই সাধারণ - কিন্তু এর শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যমে টেলিফিল্মটি আমাদেরকে গল্পের নিচের গল্পটি বের করতে সাহায্য করে। এর ঠিক প্রত্যেকটি দৃশ্যই পরিমিতি প্রকাশ করে তা নয়, কিন্তু যেগুলো করে সেগুলোর প্রভাব অনেক শক্তিশালী। নিঃসন্দেহে বলা যায় ছবিয়াল রিইউনিয়ন-এর এই এপিসোডটি অসম্ভব সৌকর্যপূর্ণ।
Comments
Post a Comment